বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েকে সামলাতে অভিভাবকদেরও ধৈর্য ধরা দরকার। কী বলছেন, মনোরোগ চিকিৎসক? ছবি: সংগৃহীত।
বয়ঃসন্ধির কালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলি হঠাৎ করেই জীবনে চলে আসে। সেই বদলের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে হিমশিম খায় বহু ছেলেমেয়েই। এই সময় তাদের আবেগ, আচরণ নিয়ে কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন অভিভাবকেরাও। কথায় কথায় রাগ, এই ভাল, এই খারাপ মেজাজের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেন না বাবা-মায়েরাও। এমন সময় কী করণীয়, কেনই বা এই বয়সে এমনটা হয় বললেন মনোরাগ চিকিৎসক শর্মিলা সরকার ও মনোসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ।
মনোরোগ চিকিৎসক শর্মিলা বলছেন, ‘‘বয়ঃসন্ধির সময়কালটা এমনই। এই সময় ছেলেমেয়েদের শরীরে হরমোনের বিশেষ তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। যা তাদের মেজাজ ও মনে প্রভাব ফেলে। এই সময় যৌন হরমোনের নিঃসরণ বেশি হয়। শরীর ক্রমশ যৌবনের দিকে এগোতে থাকে। ফলে ছেলে বা মেয়ে, উভয়েরই শরীরে বদল আসে। এই সময় কিছু নিউরনের ‘কানেক্টিভিটি’ বা সংযোগের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে। যার ফলে মনোজগতে প্রভাব পড়ে। হরমোনের প্রভাব মস্তিষ্কেও পড়ে।’’
তাঁর কথায়, মেজাজের উপর প্রভাব ফেলে সেরোটোনিন নামে হরমোন। নিউরো হরমোন সঠিক ভাবে কাজ না করলেও মেজাজ খারাপ থাকতে পারে। মোহিত বলছেন, বয়ঃসন্ধির সময় কখনও দেখা যায়, এই মন ভীষণ ভাল, আবার পর ক্ষণেই বিরক্তি।
অভিভাবকেরা কী করবেন?
১. সন্তানের এই মেজাজ বদলের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক সময় নাজেহাল হয়ে পড়েন অভিভাবকেরাও। প্রভাব পড়ে সম্পর্কেও। সামান্য কারণেই হয়তো বাবা-মায়ের উপর চিৎকার করে বসল সন্তান। এক-আধ বার হলে সমস্যা নেই, কিন্তু তা বার বার চলতে থাকলে বাবা-মায়েরাও ভেবে উঠতে পারেন না, কী করবেন? মনোরোগ চিকিৎসক বলছেন, ‘‘এই সময় ব্যালান্স পেরেন্টিং প্রয়োজন। অর্থাৎ, সন্তানকে বুঝতে হবে, তার কার্যাবলি নজরেও রাখতে হবে, আবার তাকে ছাড়ও দিতে হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, সন্তানকে স্বাধীনতা দিয়ে কোনও খেয়াল রাখবেন না। ছোট থেকেই যদি এমন অভিভাবকত্বে শিশু বড় হতে থাকে, তা হলে বঃসন্ধির দোরগোড়ায় পৌঁছে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অনেক সময় বাবা-মায়ের মধ্যে সু-সম্পর্কের অভাব বা নিরাপত্তাহীনতা তাদের জীবনে বাড়তি সমস্যা তৈরি করে।’’
২. মোহিতের পরামর্শ, ছেলেমেয়ে যদি চিৎকার করে সেই সময় অন্য পক্ষকে থেমে যেতে হবে। পরে যখন পরিস্থিতি শান্ত হবে, তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, কিছু হয়েছে কি না। যে কোনও সমস্যায় বাবা-মা পাশে থাকবেন, এই ভরসাটুকু সন্তান পেলে তাদের পক্ষেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজতর হতে পারে।
৩. “সন্তানের ভাবনা বুঝতে হলে, বাবা-মাকেও নিজেকে সন্তানের জায়গায় রেখে বিষয়টি ভাবতে হবে”, বললেন শর্মিলা। অনেক সময় সন্তান ও অভিভাবকের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব তৈরি হয়। বাবা-মায়ের উচিত ছেলেমেয়েকে বোঝার চেষ্টা করা। সে যাতে নির্ভয়ে মনের কথা বলতে পারে, সেই বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা।
কিন্তু এই বয়সের ছেলেমেয়েরা কি সব কথা সত্যিই অভিভাবকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে? গোপন ভাল লাগা বা প্রেমের সম্পর্কের টানাপড়েন— এই সব কথা কি বাবা-মাকে বলা যায় সব সময়? মোহিত বলছেন, “যদি মনে হয়, সন্তান ভাল নেই বা হয়তো বাবা-মায়ের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলে না, সে ক্ষেত্রে কোনও আত্মীয় বা শিক্ষক, যার সঙ্গে তার আদানপ্রদান বেশি, তাঁদের অনুরোধ করা যেতে পারে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য। প্রয়োজনে কাউন্সিলরের সাহায্যও নেওয়া যেতে পারে।”
৪. শর্মিলা বলছেন, ‘‘এই বয়সের ছেলেমেয়েদের অনেকেই মিথ্যে কথা বলা শুরু করে। হয়তো স্কুলে যাচ্ছে না, কিন্তু সে কথা বাড়িতে জানতেই পারছে না। আবার অনেক সময় নেশা করার প্রবণতাও তৈরি হয়। অভিভাবকেরা যেমন ‘হেলিকপ্টার পেরেন্টিং’-এর মতো সব সময় ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলবেন না, তেমনই তারা কোথায় কী করছে, খবরাখবর রাখার চেষ্টা করতে হবে। কাদেরসঙ্গে মিশছে, অভিভাবকে জানতে হবে।’’ শর্মিলার মতে, এ ক্ষেত্রে শুধু সন্তান নয়, সন্তানের বন্ধুদের সঙ্গেও অভিভাবকদের সদ্ভাব থাকলে, অনেক খবরাখবর পাওয়া যায়।