— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
বাড়িতে যে কোনও যন্ত্র থাকলে তার রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে আমরা যতটা ওয়াকিবহাল থাকি, অধিকাংশ মানুষই নিজের শরীর সম্পর্কে ততটা সচেতন নন। অথচ শরীরও যন্ত্রের মতো, তাই একটা বয়সের পরে নিয়মিত হেলথ চেকআপ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন। হার্ট, লাংস, কিডনি, হাঁটু, দাঁত, কান, চোখ, রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় শরীরের খুঁটিনাটি।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনও নির্দিষ্ট বয়স নেই। ‘‘যে কোনও বয়সে একাধিক কারণে স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। যেমন কোনও অসুখ প্রতিরোধ করতে আগাম সাবধানতার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা দরকার, যাকে আমরা প্রিভেনটিভ মেজার বলি। কোনও অসুখের আশঙ্কা যদি থাকে তা জানতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা। এ ছাড়া নতুন চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে, বিদেশ যাত্রা, স্বাস্থ্য বিমা করানোর আগে, বাচ্চাদের স্কুলে বা আউটডোর গেমে ভর্তি করানোর আগেও নানা কারণে রুটিন চেকআপ করা হয়,’’ বললেন জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. অরুণাংশু তালুকদার।
আগাম সাবধানতা
সাধারণত চিকিৎসকেরা ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সিদের দুই বা তিন বছরে একবার এবং ৫০ বছরের পর থেকে আমৃত্যু, বছরে অন্তত একবার করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। ৫০-এর পরে পুরুষ, নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বছরে একবার রক্তে শর্করা, হিমোগ্লোবিন, টিএসএইচ, ভিটামিন ডি, ক্যালশিয়াম, লিপিড প্রোফাইল টেস্ট, উচ্চ রক্তচাপ, ইসিজি, দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি পরীক্ষা করাতে হবে। এখন গ্রামে, মফস্সলে সরকারি স্বাস্থ্য দফতর থেকে বিভিন্ন ব্লকে বাড়ি গিয়ে ষাটের উপরে ব্যক্তিদের ছ’মাস অন্তর বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু কমবয়সিদের ক্ষেত্রে বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা সচরাচর ভাবা হয় না। “সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করলে ৪০-৫০-এর আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কোনও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ২০-২৫ বছর বয়সে ১০০ কেজি ওজন হয়ে গেলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। যে সব পরীক্ষা ৪০-৫০-এর পরে করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়, এদের ক্ষেত্রে তা আগেই করাতে হতে পারে। এ ছাড়া যাঁদের রক্তের সম্পর্কের মধ্যে ডায়াবিটিস, থাইরয়েডের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, গ্লকোমা ইত্যাদি রোগের ইতিহাস আছে, তাঁদের ৩০-এর পর থেকেই সচেতন হতে হবে। বছরে বা দু’বছরে অন্তত একবার রক্তে শর্করার মাত্রা দেখার জন্য এইচবিএওয়ানসি, থাইরয়েডের সমস্যা হয়েছে কি না জানতে টিএসএইচ করা যায়। যাঁরা ওবেসিটিতে আক্রান্ত তাঁরা বছরে একবার ইকোকার্ডিয়োগ্রাম, লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করে রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাই-গ্লিসারাইডের মাত্রা চেক করাতে পারেন। সচেতন থাকতে হবে পরিবারে কারও গ্লকোমা থাকলে। যদি মা, মাসির জরায়ুর ক্যানসারের ইতিহাস থাকে, তা হলে মহিলাদের ৪০-এর পর থেকে বছরে অন্তত একবার প্যাপ টেস্ট করানো জরুরি। এ ছাড়া নিজেকেই স্তন পরীক্ষা করতে হবে। হাত দিয়ে চেক করুন স্তনে শক্ত মাংসপিণ্ডের অনুভূতি হচ্ছে কি না। অবশ্যই পরীক্ষার রিপোর্ট চিকিৎসককে দেখাবেন। রিপোর্ট দেখে নিজের মতো করে ওষুধ খাওয়া বা ডায়েট বদলানো ঠিক নয়,’’ বললেন ডা. তালুকদার।
রোগের আশঙ্কা এড়াতে
শরীরে একটি রোগ বাসা বাঁধলে ভবিষ্যতে সে আরও একাধিক রোগের জন্ম দিতে পারে। এই সম্ভাবনা এড়াতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি। যেমন, দীর্ঘদিন স্ট্রেসের মধ্য দিয়ে চললে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস তৈরি হয়, যা জন্ম দেয় ফ্যাটি লিভারের। এর ফলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে, হার্টের সমস্যা ডেকে আনে, ইনসুলিনের কাজে বাধা দেয়। ফলে ডায়াবিটিসের শঙ্কা তৈরি হয়। ডায়াবিটিসের ফলে চোখ, কিডনি, হার্টের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ‘‘২০, ৩০ বা ৪০ যে বয়সেই ডায়াবিটিস ধরা পড়ুক, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হার্ট, কিডনি, চোখ সুস্থ আছে কি না, তা বছরে অন্তত একবার পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি,” পরামর্শ দিলেন ডা. তালুকদার। ওবেসিটি, থাইরয়েডের সমস্যাও যে কোনও বয়সেই হতে পারে। থাইরয়েড়ের সমস্যা থেকে হার্টের, ওবেসিটি থেকে হার্ট, ফ্যাটি লিভার, অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস, হরমোন ও ইমিউনিটির সমস্যা, অবসাদ ইত্যাদি হাজারো রোগের সূচনা হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে সর্দি কাশি, জ্বরের প্রকোপ বাড়ে, যে কোনও বড় অসুখ থেকে সেরে উঠতে সময় লাগে।
বাচ্চাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা
বাচ্চাদের জন্ম থেকে ১৮ মাস অবধি এক-দেড় মাস অন্তর ভ্যাকসিনেশন হয়। ভ্যাকসিন দেওয়ার আগে বাচ্চাটির শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ঠিক মতো হচ্ছে কি না তা চিকিৎসক দেখে নেন। ফলে দু’বছর অবধি অনেক বারই স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। এই প্রসঙ্গে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রভাসপ্রসূন গিরি বললেন, “যদি ছ’মাসের পরে বাচ্চার কোনও কারণে রক্ত পরীক্ষা করার দরকার পরে সে ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়ার স্ক্রিনিং টেস্ট (এইচপিএলসি) করিয়ে রাখা ভাল। স্কুলে ভর্তির সময়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট লাগে। স্কুল জানতে চায়, ভ্যাকসিনেশন কমপ্লিট কি না। পাশাপাশি দেখে বাচ্চাটির উচ্চতা, ওজন, দৃষ্টি ও শ্রবণ শক্তি, ব্লাড গ্রুপ, অ্যাল্যার্জি ও কোনও বড় অসুখ আছে কি না। এর পরে সে রকম ভাবে কোনও ক্রনিক সমস্যা না থাকলে মধ্য বয়স পর্যন্ত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। যাঁদের ক্রনিক কিডনি, হার্ট বা অ্যাজ়মার সমস্যা আছে, তাদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে যেতেই হবে।” শুধু স্কুলে নয়, কাবাডি, ফুটবল, মার্শাল আর্ট, ক্রিকেট, সাঁতার এই ধরনের আউটডোর গেমে দেওয়ার আগে দেখে নেওয়া ভাল বাচ্চা বা কিশোর ছেলে বা মেয়েটির হার্ট ও ফুসফুসের সমস্যা, রক্তাল্পতার সমস্যা, ক্যালশিয়াম ও ভিটামিন ডি-র খামতি নেই তো!
স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে সচেতনতা
অনেকেই ধন্ধে পড়েন হাসপাতাল, ক্লিনিকের সুলভে হেলথ চেকআপ প্যাকেজের বিজ্ঞাপন দেখে। এই প্রসঙ্গে ডা. তালুকদার বললেন, “কারও যদি মনে হয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা প্রয়োজন, তা হলে আগে পরিচিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে বলুন কেন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে চাইছেন। কোনও ফ্যামিলি হিস্ট্রি আছে কি না বা আপনার শরীরে কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, তা-ও বলুন। অনেকেই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে একগাদা টেস্ট করে নেন। এতে অযথা দুশ্চিন্তা ও অর্থব্যয় হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষা মানে শুধু রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি, আলট্রাসোনোগ্রাফি, ইউরিন, স্টুল টেস্ট নয়। চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণটাই আসল। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।’’ তবে শুধু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করালেইসমস্যা মিটবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলতে হবে ও দরকারে ওষুধ খেতে হবে।
মডেল: সুস্মেলি দত্ত, অতীন লাহা; মেকআপ: অঙ্কিতা দত্ত;
ছবি: অমিত দাস