বই পড়া গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ
বাংলা তারিখ কবেই দুয়োরানি! তবু পয়লা বৈশাখ কিছুটা জেগে আছে এখনও। বাংলা নববর্ষ মানেই নতুন পোশাক, উৎসবের মিষ্টি। পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশে যে আবেগ ও ভালবাসায় এই দিনটি উদযাপিত হয়, তার তুলনায় এখানে কিছুই হয় না। তবু পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, অসমের বরাক উপত্যকায় বাঙালি মনে রাখে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটিকে। সারা বছরের বাধ্যতামূলক বেঁচে থাকার খোলস ফেলে জেগে ওঠে বাঙালিত্ব। আড্ডায় আড্ডায় আক্ষেপ-- ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’। কথিত, সম্রাট আকবরের সময়ে চালু হয় এই দিনটির উৎসব। চৈত্র মাসের শেষ তারিখে খাজনা মিটিয়ে দিতেন প্রজারা। পরের দিন সম্রাটের তরফে মিষ্টিমুখ করানো হত তাঁদের। সেই সময়েই চালু হয় হালখাতা। দোকানিরা পুরনো বছরের হিসেবের খাতা ফেলে দিয়ে নতুন হিসেবের খাতা চালু করতেন। কালের নিয়মে কবেই রাজা-জমিদাররা চলে গিয়েছেন, কিন্তু পয়লা বৈশাখ ঘিরে নতুন পোশাক, মিষ্টিমুখ প্রথা হিসেবে থেকে গিয়েছে কমবেশি। ক্রমে বদলে যায় সমাজ। নববর্ষে ও অক্ষয় তৃতীয়ায় ‘হালখাতা’ টিকে আছে এখন কেবল মফস্সল-গ্রামের ছোট ছোট দোকানে আর নগরে বনেদিয়ানায় বিশ্বাসী কিছু প্রাচীন প্রতিষ্ঠানে। ইদানীং বাংলাদেশের সুপ্রভাবে বর্ষবরণের সকালে অনেক জায়গায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বেরচ্ছে। পান্তা- ইলিশ চলছে। চোখে পড়ছে বাঙালি ‘খানা’র বিজ্ঞাপনও। পর্দার তারকারা কেউ ধুতি-পাঞ্জাবি, কেউ লালপেড়ে শাড়িতে ফোটোশ্যুটে ব্যস্ত। তবে পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষের উৎসব অমলিন কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায়।
কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় পয়লা বৈশাখ সত্যিই অন্যরকম একটা দিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইপাড়ার অনেক কিছু বদলেছে। নববর্ষের প্রথম দিনটি কিন্তু একই রকম। প্রকাশকের ঘরে ঘরে কবি-সাহিত্যিকরা আমন্ত্রিত। ডাবের জল, সন্দেশে আপ্যায়ন। চা, সিঙারা তো আছেই। সঙ্গে আছে তুমুল আড্ডা। বইপাড়ায় নববর্ষের পুরনো আড্ডার গল্প মনে শিহরণ তোলে। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, প্রবোধকুমার সান্যালরা হয়ত কোনও এক পাবলিশার্সের ঘরে আড্ডায় বিভোর। সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, দিব্যেন্দু পালিতরা আনন্দ পাবলিশার্সের দফতরে খানিক আড্ডা দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে যাচ্ছেন অন্য প্রকাশকের অফিসে। দে’জ পাবলিশিং-এর ওখানে আসর জমিয়েছেন শংকর, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা। অগুনতি প্রকাশকের দফতরে একই দৃশ্য। নতুন বই কিনতে আসা পাঠকরা অনেকেই প্রিয় লেখকের সঙ্গে দেখা করছেন। নববর্ষের প্রথম দিনে কলেজ স্ট্রিট রমরম করে বই-উৎসবের মেজাজে। কলকাতা বইমেলা সফল হওয়ার পর প্রকাশকরা পয়লা বৈশাখের বদলে বইমেলায় প্রকাশ করেন অধিকাংশ বই। নতুন গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে তাই পয়লা বৈশাখ অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এ দিন লেখকদের কিছু অগ্রিম অর্থ প্রদানের রীতিটিও আর নেই। গত কয়েক বছরে অবশ্য নববর্ষে নতুন গ্রন্থ প্রকাশের রেওয়াজ কিছুটা ফিরে এসেছে।
বই পাড়া
প্রকাশন সংস্থা পত্রভারতী-র কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ব্যবসায়িক দিকটা পয়লা বৈশাখ থেকে সরে গেলেও ঐতিহ্যবাহী উৎসব হিসেবে অবশ্যই থেকে গেছে।
দে'জ পাবলিশিং-এর শুভঙ্কর দে অল্প বয়সে নববর্ষের আড্ডায় দেখেছেন লীলা মজুমদার, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, পূর্ণেন্দু পত্রী, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, তারাপদ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়দের। তাঁর কথায়, “আমাদের এখানে নববর্ষের আড্ডা আগের মতনই আছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। সেটাই স্বাভাবিক। নববর্ষের আড্ডায় এখন শঙ্খ ঘোষ, প্রফুল্ল রায়, মনোজ মিত্র, ভগীরথ মিশ্র, সমরেশ মজুমদার, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রচেত গুপ্তরা আসেন। আড্ডা, হাসি, কলরবে কোনও খামতি দেখি না। এই তো গত বছর লকডাউনে নববর্ষ উৎসব হয়নি। কী খারাপ লেগেছিল! এ বারের পয়লা বৈশাখের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি।”
বই পাড়া
উদগ্রীব হয়ে আছেন ডাবওয়ালা, সন্দেশের কারিগর, তেলেভাজার দোকানি। উদগ্রীব লেখক, প্রকাশকও। করোনা-র কারণে বইপাড়ার ব্যবসা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত। উৎসব এসে প্রাণ ফেরাক। সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত এই দিনটি নিয়ে বললেন, “এই দিন অনুভব করি, লেখক-প্রকাশক-পাঠক আসলে একটাই আত্মা। স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎসব ফিরুক।”
লেখক-প্রকাশক-পাঠকের মিলনমেলায় পয়লা বৈশাখ এ বার কিন্তু সব অর্থেই ‘হালখাতা’!