সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুষ্কা শর্মার পোস্ট করা একটি ছবি ভাইরাল হয়। সেখানে অভিনেত্রী শীর্ষাসন করছেন এবং তাঁকে সাহায্য করছেন স্বামী বিরাট কোহালি। এই ছবিটি ঘিরেই প্রশ্ন উঠেছে, গর্ভাবস্থায় এ ধরনের ব্যায়াম কি করা যায়? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। অভিনেতা, স্পোর্টসম্যানদের চেয়ে সাধারণ মানুষের ফিটনেস সাধারণত কম। তাঁরা যেটা পারেন, সেটা আমজনতার পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। সেরিনা উইলিয়ামস প্রেগন্যান্ট থাকাকালীন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছিলেন। অভিনেত্রী গ্যাল গ্যাডট পাঁচ মাসের গর্ভাবস্থায় ‘ওয়ান্ডার উওম্যান’ ছবির অ্যাকশন দৃশ্যের শুট করেছিলেন। গর্ভাবস্থায় অনেক ব্যায়ামই করা যায়, কিন্তু তা নির্ভর করছে ব্যক্তিবিশেষের ফিটনেসের উপরে।
সকলের শরীর এক রকমের নয়। মেডিক্যাল হিস্ট্রি, শারীরিক অবস্থা বিচার করেই শারীরচর্চার রুটিন ঠিক করা উচিত। গাইনিকলজিস্ট ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘নর্মাল প্রেগন্যান্সিতে মায়েরা এক্সারসাইজ়, যোগব্যায়াম করতে পারেন। কিন্তু হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সিতে বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। শরীরের অবস্থা বুঝে সময় ধরে হাঁটা যেতে পারে।’’ হাই রিস্ক প্রেগন্যান্সি বলতে মূলত বোঝানো হচ্ছে, যাঁদের আগে মিসক্যারেজ হয়েছে, অ্যানিমিয়া, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস বা অন্যান্য শারীরিক জটিলতা রয়েছে। চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের এক্সারসাইজ় নির্ধারণ করা উচিত নয় বলে জানালেন ফিটনেস বিশেষজ্ঞ চিন্ময় রায়। তাঁর কথায়, ‘‘গর্ভাবস্থায় কিছু এক্সারসাইজ় করা উচিত। আবার কিছু নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া প্রেগন্যান্সিতে কোনও রকম শারীরচর্চা করা উচিত নয়।’’ কিন্তু তা বলে এই অবস্থায় যে হবু মায়েদের শুয়ে-বসেই কাটাতে হবে, এমনও নয়। ডা. চট্টোপাধ্যায় জানালেন, কেন এই সময়ে এক্সারসাইজ় জরুরি—
• কার্ডিয়োভাসকুলার এক্সারসাইজ় গর্ভাবস্থায় সহায়ক। তা ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। শরীরে রক্ত চলাচল বাড়বে, রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
• এনার্জি বাড়াতে, ঘুমের সাইকেল ঠিক রাখতে, স্ট্রেস-অ্যাংজ়াইটি-ডিপ্রেশন কমাতে জরুরি। হরমোনের ভারসাম্যও ঠিক রাখবে।
• শরীর মজবুত করতে, ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়াতেও ব্যায়াম করা দরকার। এ সময়ে যেহেতু ওজন বাড়ে, তাই ব্যালান্সিংয়ের সমস্যা হয়, এটাও শারীরচর্চায় ঠিক হয়ে যায়।
• পেলভিক মাসলের জোর বাড়ানোটাও এ সময়ে জরুরি।
কোন এক্সারসাইজ় করবেন?
এই সময়ে হাঁটা হল সবচেয়ে ভাল ব্যায়াম। নিজের শারীরিক ক্ষমতা বুঝে গতি-সময় নির্ধারণ করে রোজ হাঁটুন, তবে সমতলে হাঁটবেন। বাড়িতে এক্সারসাইজ় বাইক থাকলে তাতে প্যাডল করতে পারেন বা ক্রস ট্রেনারও করা যায়।
সুইমিংয়েও উপকার হয়। বাড়ির কাছাকাছি অ্যাকোয়া অ্যারোবিক ক্লাস থাকলে, সেখানে যেতে পারেন। হালকা ওজন নিয়ে প্রশিক্ষকের কাছে কোর এক্সারসাইজ় করতে পারেন।
প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে কিছু বিশেষ ধরনের যোগব্যায়াম এবং পিলাটিস করলে ভাল উপকার পাওয়া যায়। তবে পেট যখন ক্রমশ বড় হতে থাকবে তখন যোগাভ্যাসের ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দিতে হবে। সব ধরনের যোগব্যায়াম করা যাবে না।
পেলভিক মাসলের জোর বাড়ানোর এক্সারসাইজ় করাও উচিত। সন্তান জন্মানোর পরে পেটের নীচের অংশ থলথলে হয়ে যায়। আগে থেকে এ সংক্রান্ত ব্যায়ামগুলি করলে ভাল। নর্মাল ডেলিভারিতেও তা উপকারী। অনেকের গর্ভাবস্থায় টয়লেট চেপে রাখতে সমস্যা হয়। পেলভিক মাসলের এক্সারসাইজ় এই সমস্যাগুলির সমাধান করে দেয়।
এই সময়ের জন্য চারটি বিশেষ ব্যায়ামের কথা উল্লেখ করলেন চিন্ময় রায়— প্লাঙ্ক, সাইড প্লাঙ্ক, ব্রিজ এবং বার্ড ডগ এক্সারসাইজ়। প্লাঙ্ক ও সাইড প্লাঙ্কের সময়ে শরীরের ভারসাম্যের দিকে খেয়াল রাখবেন। প্রথমটি ১০-২০ সেকেন্ড করে দু’বার। দ্বিতীয়টি চার-পাঁচ বার করতে পারেন। ব্রিজের সময়ে মেঝেতে সোজা হয়ে শুয়ে, পা মুড়ে পেটের দিকে টেনে কোমর উঁচুতে তুলে ধরুন। ২০ সেকেন্ড ধরে রেখে, নামিয়ে নিন। এ ভাবে চার বার করুন। পেলভিক মাসলের জোর বাড়ানোর জন্য ব্রিজ ভাল ব্যায়াম। বার্ড ডগ এক্সারসাইজ় করার সময়ে হামাগুড়ি পজ়িশন নিন। ডান হাত সামনের দিকে আর বাঁ পা পিছন দিকে সোজা করে দিন। এটা অল্টারনেট করে মোট দশ বার করুন।
কোনগুলি করবেন না
অনুষ্কা তাঁর পোস্টে লিখেছেন, তিনি চিকিৎসকের পরামর্শ মেনেই শীর্ষাসন করেছেন। এই ব্যায়ামটি তিনি দীর্ঘ দিন ধরে করে আসছেন, তাই তাঁর কোনও শারীরিক সমস্যা হয়নি। তবে অনুষ্কার শীর্ষাসন প্রসঙ্গে ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এই ধরনের বিষয়গুলো সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ওঁর শারীরিক কন্ডিশন আমাদের জানা নেই কিন্তু প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে শীর্ষাসন করা উচিত নয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ মহিলাই ঠিক মতো শারীরচর্চা করেন না। তাই কোনও তারকাকে দেখে দুম করে কিছু করা উচিত নয়। নিয়মিত হাঁটা আর পেলভিক মাসলের ব্যায়ামগুলোই যথেষ্ট।’’ দৌড়নো, জগিং, লাফানো, সাইক্লিং, স্টেপ এরোবিক্স, ভারী ওজন তুলে ব্যায়াম করায় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে জানালেন তিনি। বাদ রাখতে হবে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসও। শীর্ষাসন না করার পরামর্শ দিলেন চিন্ময় রায়ও।
খেয়াল রাখুন
ব্যায়ামের সময়ে শরীর খারাপ লাগলে, করবেন না। নিঃশ্বাসের কষ্ট, বুকে ব্যথা, পেশিতে টান বা পেটের কোনও অংশে যন্ত্রণা হচ্ছে কি না খেয়াল রাখুন। গর্ভাবস্থায় সনা বা স্টিম বাথ না নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। একনাগাড়ে ৩০ মিনিটের বেশি ব্যায়াম করবেন না। সপ্তাহে পাঁচদিন ব্যায়ামই যথেষ্ট। চিৎ হয়ে ১০ মিনিটের বেশি শুয়ে থাকবেন না। এক্সারসাইজ়ের মাঝে অল্প জল খাবেন। কার্বোহাইড্রেট খাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট পরে ব্যায়াম করবেন।
চিকিৎসকের পরামর্শ এবং নিজের শারীরিক অবস্থা বুঝেই সবটা করবেন। যাঁরা আগে একেবারেই শারীরচর্চা করতেন না, তাঁরা ধীরে ধীরে ব্যায়ামের সময় বাড়াবেন।