সমাজে পরিচিত কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শুরু হয় বাহ্যিক কারণের চুলচেরা বিশ্লেষণ। অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যা অনুমান করে নিয়েই মৃতের মন বুঝতে চলে তাঁর পূর্ব আচরণের ‘ময়না-তদন্ত’। গণমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমে ‘বিচারসভা’ বসিয়ে বিভিন্ন জনকে দায়ী সাব্যস্ত করাও হয়। সম্প্রতি এক অভিনেত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরেও তেমনটাই দেখা যাচ্ছে।
আত্মঘাতী হয়েছেন ধরে নিয়ে বাহ্যিক কারণটিই মুখ্য ভেবে বসছি অনেকে। যেটা একমাত্রিক ভাবনা। অথচ ঘটনাটি যদি আত্মহত্যা হয়েও থাকে, মনে রাখতে মানসিক সমস্যা শুধুমাত্র বাহ্যিক ঘটনার অভিঘাত নয়। আমাদের মনের কয়েকটি উপাদান, যেমন— বংশগতির বৈশিষ্ট্য , শৈশবের অভিজ্ঞতা এবং এই দুইয়ের মিশেলে গড়ে ওঠা চিন্তা-ভাবনা-দৃষ্টিভঙ্গি-আবেগ প্রকাশের ধরন ও স্নায়ুপ্রেরক বা নিউরোট্রান্সমিটারের ভূমিকাও মনের কোণে লুকোনো থাকে। এই সব উপাদানের সঙ্গে আমাদের জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে। বাইরের এবং ভিতরের এই উপাদানগুলোর থেকে শুধু একটা কারণকেই বেছে নেব? সেটাও আবার কী পদ্ধতিতে? উত্তর আজও অজানা!
পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি মিনিটে বিশ্বের কোথাও না কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। কী দৃষ্টিতে দেখি আমরা আত্মহত্যা কিংবা তার চেষ্টাকে? কিছু দিন আগে পর্যন্ত এ দেশের আইন দেখত অপরাধ হিসাবে। সাধারণ মানুষের ভাবনায় কখনও তা কাপুরুষতা, কখনও বা লজ্জা-নিন্দার, কখনও আবার পারিবারিক কলঙ্ক, কখনও সহানুভূতির! এই সব দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই রয়েছে অজ্ঞতা, ভ্রান্ত ধারণা ও অসংবেদনশীলতা।
আত্মহত্যার ঘটনায় জড়িয়ে থাকে মনের যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত। কোনও ক্ষেত্রে বিশেষ ঘটনার তীব্র অভিঘাতে বিপর্যস্ত মনেও আত্মহত্যা সম্ভব। আমরা শরীর নিয়ে যতটা ভাবি, মন বা তার যন্ত্রণা নিয়ে ততটা নয়। বহু ক্ষেত্রেই মনের বিভিন্ন অসুখ, বিশেষ করে বিষণ্ণতা আত্মহত্যার গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সাধারণ মন খারাপ সবার হয়। কিন্তু বিষণ্ণতায় মন খারাপের তীব্রতা এবং ব্যাপ্তি তুলনামূলক বেশি এবং যথেষ্ট কষ্টকর।
বিষণ্ণতা আমাদের চিন্তাকে নেতিবাচক খাতে প্রবাহিত করে। মনে হয়, কিছুই হল না জীবনে, সব ব্যর্থ, তার দায় আমারই! মনে হয়, কেউ পাশে নেই, কেউ বোঝে না আমার মনের কথা! সামনে কোথাও আলোর রেখা নেই। নতুন কিছু হওয়ার নেই। এর পরেই যে ভাবনা হানা দেয়, তা হলে আর থেকেই বা কী হবে! চলে যাওয়াই শ্রেয়! এই নেতিবাচক চিন্তার প্রবাহই ঠেলে দেয় আত্মহত্যার দিকে।
বিষণ্ণতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবে চিরস্থায়ী নয়। মন কখনও সরলরেখা ধরে চলে না, তার নামা-ওঠা আছে। বেশিরভাগ বিষণ্ণতার পর্ব শেষে তাই আশার আলোও দেখা দেয়। বিষণ্ণতা কমলেই কমতে শুরু করে নেতিবাচক চিন্তার স্রোত। আবার জীবনের মানে খুঁজে পেতে শুরু করি।
মন আছে বলেই মন অসুস্থ হয়। বেশির ভাগ মনের অসুখই স্বল্পমেয়াদি। খুব অল্প কয়েকটি মনের অসুস্থতা ক্রনিক বা দীর্ঘকালীন। এই দু’ধরনের অসুস্থতারই চিকিৎসা রয়েছে। বিষণ্ণতাকে ক্রনিক অসুখের তালিকায় রাখা হয়নি। এরও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা রয়েছে। বিষণ্ণতার ক্ষেত্রে স্নায়ুপ্রেরকের ভারসাম্যের অভাব গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে অনেক ক্ষেত্রেই মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধের প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া কাউন্সেলিং এবং সাইকোথেরাপিও গুরুত্বপূর্ণ। বিষণ্ণতায় আমাদের চিন্তা-ভাবনার ধরন, দৃষ্টিভঙ্গি, আবেগ সামাল দেওয়ার পদ্ধতির মধ্যেই থাকে মনের অসুস্থতার কারণ। কাউন্সেলর কিংবা মনোবিদের সাহায্য এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশপাশের মানুষের সংবেদনশীল এবং সহমর্মী আচরণও যথেষ্ট জরুরি।
বিষণ্ণতা এবং এর চিকিৎসা সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা, উদাসীনতা, অবহেলার মূল্য দিতে হয় দুর্ঘটনার পরে। যদি আমরা আগেই সচেতন, একটু সংবেদনশীল হয়ে উঠি, তা হলে হয়তো বেশ কিছু অবধারিত আত্মহত্যা প্রতিহত করা সম্ভব।