আয়না। নিতান্তই মামুলি একটি বস্তু। আয়নাহীন বাড়ি কল্পনা করাই দুরূহ। দিনের মধ্যে একাধিক বার মানুষ নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে আয়নার সামনে আসেন। প্রাত্যহিকের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা এই বস্তুটিই যে কখন অচেনা হয়ে যায় আর তা হয়ে দাঁড়ায় ভয়ের বিষয়, সে বৃত্তান্ত জানলে অনেকেরই সমস্যা দেখা দেবে আয়নার সামনে দাঁড়াতে। ভূত চতুর্দশীর গা ছমছমে লগ্নে এখানে রইল আয়না নিয়ে কিছু অপ্রাকৃত সুলুক-সন্ধান।
আয়নাকে প্রাচীন রোমে রীতিমতো ভয় করা হত। মনে করা হত, কোনও কোনও আয়নার ভিতর দুষ্ট আত্মা বন্দি থাকে। তেমন আয়না কেউ কিনে বাড়ি নিয়ে এলে, তাঁর ভোগান্তি অপরিসীম।
আয়না নিয়ে সংস্কার সব দেশের সংস্কৃতিতেই বহমান। ইউরোপ ও আমেরিকায় আজও মনে করা হয়, বাড়িতে কোনও প্রিয়জন মারা গেলে আয়নাগুলিকে কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখা প্রয়োজন। নইলে মৃত ব্যক্তির আত্মা আয়নার মধ্যে বন্দি হয়ে থাকবে। শোনা যায়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের মৃত্যুর পর নাকি হোয়াইট হাউসের সব ক’টি আয়না কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছিল। (সঙ্গের ছবিটি জর্জ পিটার আলেকজান্ডার হিলির আঁকা লিঙ্কনের তৈলচিত্র)
অগণিত ভয়ের সাহিত্যে আয়নাকে ইহজগৎ এবং পরলোকের মধ্যবর্তী পথ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাস্তবের প্রতিফলন ছাড়াও নাকি অনেক কিছু ঘটে চলে আয়নার ভিতরে। কিন্তু মজার ব্যাপার এই, ভূতেদের ছায়া নাকি আয়নায় পড়ে না। ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র জোনাথন হার্কার তার ডায়েরিতে উল্লেখ করে, কাউন্ট ড্রাকুলার প্রাসাদে কোনও আয়না ছিল না। কারণ ভ্যাম্পায়ার কাউন্টের ছায়া আয়নায় পড়ত না। ১৯৩১-এর আমেরিকান ছবি ‘ড্রাকুলা’-র ‘আয়না দৃশ্য’ বিখ্যাত হয়ে রয়েছে কাউন্টের এই প্রতিবিম্বহীনতার কারণেই। (সঙ্গের ছবিটি সেই ছবিতে ড্রাকুলার ভূমিকায় বেলা লুগোসির।)
এক সময়ে চিনে এমন বিশ্বাস ছিল যে, আয়নার সামনে দিয়ে যদি কোনও মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়, তা হলে সেই মৃত ব্যক্তি ভূতে পরিণত হবেন। এবং সেই প্রেতদশা হবে অতৃপ্ত। আবার জার্মান বা ওলন্দাজদের বিশ্বাস ছিল, কোনও প্রিয় জনের প্রয়াণের পরেই যদি কেউ আয়নায় নিজেকে দেখেন, তা হলে তাঁর মৃত্যু একেবারে ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে।
ইউরোপের আর এক বিশ্বাস, আয়না ভাঙলে নাকি টানা সাত বছর দুর্ভাগ্যের খপ্পরে পড়তে হয়। এর মূলে রয়েছে প্রাচীন রোমের এক সংস্কার। যেখানে বলা হয়েছে, মৃত ব্যক্তির আত্মা প্রতি সাত বছর অন্তর জেগে ওঠে আর আয়নায় তা প্রতিফলিত হয়। আর সেই পুনরুত্থানই নাকি দুর্ভাগ্য ডেকে নিয়ে আসে।
আয়নায় প্রতিফলিত দুষ্ট আত্মা নিয়ে পশ্চিমী বিশ্বের প্রচলিত রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। তার মধ্যে অন্যতম হল ‘ব্লাডি মেরি’। প্রচলিত বিশ্বাস, এটি নাকি এক দুষ্ট আত্মা নামানোর খেলা। ঘর অন্ধকার করে একটি আয়নার সামনে মোমবাতি জ্বালিয়ে তিন বার ‘ব্লাডি মেরি’-কে আহ্বান করতে হয়। এবং এক সময়ে নাকি সে আয়নায় দৃশ্যমান হয়।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় আয়না ব্যবহার করে আত্মা নামানোর কালো জাদু প্রচলিত ছিল। রানি এলিজাবেথের সময়কার ইংরেজ দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ জন ডী পাথরের তৈরি এক কালো আয়না ব্যবহার করে অপ্রাকৃত জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতেন বলে কথিত আছে। তাঁর সেই আয়না মেক্সিকো থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই সূত্র থেকে জনা যায়, মায়া, আজটেক সভ্যতাতেও চল ছিল কালো আয়না বা ‘ব্ল্যাক মিরর’ ব্যবহার করে আত্মা নামানোর। এই প্রক্রিয়া কালো জাদুর জগতে ‘স্ক্রাইং’ নামে পরিচিত। (সঙ্গের ছবি জন ডী এবং তাঁর ব্যবহৃত জাদুসামগ্রীর। এগুলির মধ্যে কালো আয়নাটিও রয়েছে।)
সাহিত্যে ‘ভৌতিক’ আয়নার কথা বার বার এসেছে। আয়নাকে অন্য সময় ও পরিসরে যাওয়ার প্রবেশপথ হিসেবেও যে ব্যবহার করা হয় এ কথা রয়েছে দেশ-বিদেশের বেশ কিছু কাহিনিতে। তবে হলিউডি ভয়ের ছবিতে ঘুরে ফিরে এসেছে আয়নার প্রসঙ্গ। স্টিফেন কিংয়ের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৭৬ সালের ছবি ‘ক্যারি’-তে এক অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন মেয়ের কাহিনি বর্ণনায় আয়না খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
২০১১-র ভৌতিক ছবি ‘প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটি’-তে ব্লাডি মেরি কিংবদন্তি ব্যবহৃত হয় এবং তার অনিবার্য ফল হিসেবে আয়নায় ভেসে ওঠে অবাঞ্ছিত আত্মার প্রতিচ্ছবি।
১৯৮২-র ছবি ‘পোল্টারগাইস্ট’-এ মার্টি নামের এক প্যারাসাইকোলজিস্টের আয়নায় ভেসে ওঠে ঘোর বিভীষিকা।
তবে আয়না সংক্রান্ত ভয়ের ছবি হিসেবে সব থকে উল্লেখযোগ্য উদাহরণটি হল ২০১৩-র ছবি ‘ওকুলাস’। এক প্রাচীন আয়নাকে ঘিরে ঘনিয়ে ওঠা নানা অমঙ্গল এই ছবির কাহিনির কেন্দ্রে। ‘ওকুলাস’ শব্দটির অর্থ ‘গোলাকার জানালা’। অতিপ্রাকৃত চর্চাকারীরা একে চোখের সঙ্গে তুলনা করেন। সে ক্ষেত্রে ওকুলাস এমন একটি চোখ, যা সকলকে নির্নিমেষ ভাবে দেখে চলেছে। কিন্তু এই চোখ বা জানলার ও পারের জগতের সন্ধান এ পারের মানুষের জানা নেই।