গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আরজি কর-কাণ্ডের পর নারী সুরক্ষার দাবিতে সরব হয়েছে কলকাতা। নিরাপত্তা চেয়ে রাজপথে নেমেছেন মহিলারা। উঠেছে রাত দখলের ডাক। বুধবার তেমনই এক কর্মসূচি ছিল রাজ্য জুড়ে। শ্যামবাজারের জমায়েতে প্রতিবাদে শামিল হতে এসেছিলেন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। কিন্তু সেখান থেকে তাঁকে ‘অসম্মানিত’ হয়ে ফিরে যেতে হয়। প্রবল বাধার মুখে পড়ে এক প্রকার বাধ্য হয়েই ফেরার পথ ধরেন ঋতুপর্ণা। এই ঘটনার পরেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি এই আন্দোলনের রূপরেখা বদলে যাচ্ছে? মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে যে গণ অভ্যুত্থানের জন্ম, সেই আন্দোলনে পা মেলাতে এসেই হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে অত্যন্ত পরিচিত এক নারীকে। তা হলে যে মেয়েটির আলাদা কোনও পরিচিতি নেই, এ শহরে তাঁর নিরাপত্তা কোথায়, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণার সঙ্গে এমন ঘটায় প্রতিবাদে সমাজমাধ্যমে সরব হয়েছেন অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী। তিনি লিখেছেন, ‘‘রাত দখলের লড়াইয়ের উদ্দেশ্য যে মেয়েদের নিরাপত্তা আদায় করে নেওয়া, সেটা কি সকলে ভুলে যাচ্ছেন? নারীর সম্মান, সম্ভ্রম এবং সুরক্ষার জন্যই রাস্তায় নামতে হয়েছে। সেখানে একজন নারীর সঙ্গে এই ধরনের ব্যবহার কি করা যায়?’’ প্রশ্ন তুলেছেন সুদীপ্তা। বুধবার রাতের পর ধাতস্থ হতে সময় নিয়েছেন ঋতুপর্ণা। কিন্তু প্রতিবাদীদের ভয়ঙ্কর রূপ তিনি ভুলতে পারছেন না। চেনা কলকাতা, প্রতিবাদের আতুঁড়ঘর এই শহরের রক্তচক্ষু মেনে নিতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। সেই যন্ত্রণা প্রকাশ করে আনন্দবাজার অনলাইনের পাতায় ঋতুপর্ণা লিখলেন, ‘‘বুঝতে পারছি, সকলেই ক্ষুব্ধ। তবে, কলকাতার প্রতিবাদী চেহারার মধ্যে এই চেহারাটা দেখে আমি লজ্জিত, আহত, কম্পিত। বুধবার রাতে আমার প্রাণটাও চলে যেতে পারত। আমি একজন অরাজনৈতিক, নিরপেক্ষ মানুষ হিসাবে, একজন মহিলা হিসাবে অন্য মহিলার পাশে দাঁড়াতে এসেছিলাম। কিন্তু বিরাট সংখ্যক মত্ত এই ঘটনা ঘটাল।’’
ঋতুপর্ণার ঘটনার পরে এই লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন একসময়ের অভিনেত্রী এবং বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ও। সুদীপ্তার মতো তিনিও সমাজমাধ্যমে ঋতুপর্ণাকে হেনস্থার প্রতিবাদে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। রূপা স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন, ‘‘ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে বিনা কারণে অপমান করা আমি সমর্থন করি না, করব না। এই নাকি নারী সম্মান, নারী সুরক্ষার লড়াই?’’
নিরাপত্তা অধিকার হলেও, তা ছিনিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। সেই লড়াইয়ে পথে নেমেছেন নারীরা। সঙ্গে পেয়েছেন পুরুষদেরও। গত কয়েক দিনে সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা এবং পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধতার এমন কিছু মুহূর্ত তৈরি হয়েছে, যা ইতিহাস হয়ে থাকবে। তবে খানিকটা হলেও তাল কাটল বুধবারের ঘটনায়। এই গোটা বিষয়টিকে শুধু অসহনশীলতা, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখতে নারাজ শিল্পী সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মতে, আসলে খ্যাতনামীদের অসম্মান করা খুব সহজ। কী ভাবে তাঁদেরকে ছোট করা যায়, তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছে। সুজয়প্রসাদ বলেন, ‘‘আমরা সকলেই একটা লক্ষ্যে পথে হাঁটছি। ঋতুপর্ণাও একই দাবি নিয়ে শ্যামবাজারে গিয়েছিলেন। প্রচার পেতে যাননি তিনি। ঋতুপর্ণা একজন নামী তারকা। তাঁর আর আলাদা করে প্রচারের আলোয় থাকার দরকার পড়ে না। ঋতু গিয়েছিলেন একজন মেয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর বিচার চাইতে। তাঁর সঙ্গে যেটা হল, সেটা সত্যিই ন্যক্কারজনক। আমার কলকাতা তো এমন ছিল না!’’
যে শহরে একজন মেয়ের সঙ্গে হওয়া নির্মম অত্যাচারের প্রতিবাদে শয়ে শয়ে মেয়ে পথে নামতে পারে, ঠিক সেই শহরেই একজন নারীর এমন ‘অপমান’ মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই। তবে বিষয়টিকে লিঙ্গবৈষম্যের বাইরে রেখে একজন মানুষের প্রতি এই অসম্মানজনক ব্যবহারের নিন্দা করেছেন সঙ্গীতশিল্পী অনুপম রায়। তাঁর মতে নারী কিংবা পুরুষ বলে নয়, কোনও মানুষের সঙ্গেই এই ব্যবহার করা যায় না বলেই মনে করেন তিনি। অনুপম বলেন, ‘‘ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত হলেন সফ্ট টার্গেট। মানুষের মধ্যে অনেক রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ আছে। কিছু কারণ যথাযথ হতেই পারে। সেগুলি উগরে দেওয়ার একটা জায়গা দরকার হয়। ক্ষমতাশালী মানুষেরা হলে সেটা উগরে দেওয়ার আদর্শ জায়গা। তবে আমার মনে হয় ঋতুদি যেমন মানুষ, তাতে উনি ক্ষমা করে দেবেন। অন্তত এই শহর তো সেটাই শেখায়। আর কলকাতা বলে নয়, অন্য যে কোনও শহরে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। শহর যেমন ছিল, তেমনই আছে। নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনটাই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে। কাউকে অসম্মান করা নয়।’’
শিল্পীমহল এই ঘটনার প্রতিবাদে কথা বলেছে, সমাজমাধ্যমে লিখেছে। তবে শুধু শিল্পীরা নন, অনেক সাধারণ মানুষও বুধবারের ঘটনার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। এই ঘটনা একেবারেই কাঙ্ক্ষিত নয়, সিংহভাগের মনের কথা এটাই। সকলের প্রতিবাদের ভাষা এক নয়। বিভিন্ন ভাবে এই ঘটনার নিন্দা করেছেন শহরবাসী। অনেকেরই মনে হয়েছে, ঋতুপর্ণার সঙ্গে যা হয়েছে, তা অন্যায় এবং লজ্জার। কোনও ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রতিবাদ মিছিলে গিয়ে ঋতুপর্ণার হেনস্থার ঘটনার পরে এ শহরের আবেগ, সহনশীলতার বদল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সেই প্রশ্নকে দূরে সরিয়ে এ শহর যে এখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধেই কথা বলছে, তা বোঝানোর চেষ্টাও জারি রয়েছে।