প্রতীকী ছবি।
সমাজের একটি বড় অংশ যা চায়, সেই আচরণই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। সময় যতই এগোক না কেন, এই ভাবনায় বিশেষ বদল আসেনি। এখনও আর পাঁচ জন কী করলেন, কী ভাবে চললেন, তার উপর নির্ভর করে ঠিক-ভুলের ধারণা। তার জেরে সমস্যাও কম হয় না। সময় যত বদলাচ্ছে, জীবনধারাতেও আসছে বদল। নিত্য নতুন সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। মনের কথা খুলে বলার মানুষ কম পাওয়া যাচ্ছে। আর বাড়ছে মানসিক চাপ। যেতে হচ্ছে মনোরোগ চিকিৎসক, মনোবিদের কাছে। কিন্তু সেখানে গিয়েই কি শান্তি মিলছে? অনেক ক্ষেত্রেই ততটা সহজ হচ্ছে না পরিস্থিতি। হয়তো তিনি এমনই কিছু মন্তব্য করে ফেলছেন, যাতে সমস্যা আরও বাড়ছে। খুলে কথাই বলা যাচ্ছে না মনোবিদের সঙ্গে।
কিন্তু এই প্রবণতাকে কি সমস্যা বলে চিহ্নিত করছেন মনোবিদরা? না কি রোগীর মতের উপর নিজের ভাবনা চাপিয়ে দেওয়াই স্বাভাবিক বলে মনে করেন তাঁরা? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
সেক্স এডুকেশন সিরিজের এক অত্যন্ত জনপ্রিয় অংশ ছিল মনোবিদ জাঁ মিলবার্ন।
মনো-সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় মনে করেন, পরিস্থিতি এমন হলে মনোবিদের সঙ্গে খোলাখুলি কথাই বলতে পারবেন না রোগীরা। তিনি বলেন, ‘‘রোগী এবং মনোবিদের একই ধরনের জীবনবোধ মিলে গেলে ভাল। তা না হলেও, অন্তত একে অপরের জীবনদর্শনের প্রতি সম্মান থাকা দরকার। নিশ্চই এমন কোনও মনোবিদের কাছে যেতে ইচ্ছা করবে না যিনি, আপনার সম্বন্ধ করে বিয়ের ভাবনা নিয়ে মশকরা করেন কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ বা গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নীতিগত ভাবে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। নিজের জীবনের অতি গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা মনোবিদের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন আপনি। সে ক্ষেত্রে একটি নিয়ম থাকা জরুরি যে, মনোবিদ কোনও ভাবেই আপনার সমালোচনা করবেন না।’’ রত্নাবলী মনে করান, সচরাচর মনোবিদরা রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে আসলে মনোবিদের বৃহৎ অর্থে রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে সচেতনতা প্রয়োজন।
রত্নাবলী মনে করান, মনোবিদদের প্রথম দায়িত্ব হল অন্যের মূল্যবোধ, জীবনদর্শনের সমালোচনা না করা। তবে বাকি দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোবিদরা সে কথা শুনেই এ কাজে আসেন বলে মনে করান রত্নাবলী। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সমালোচনা করব কি করব না, সে বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সকলের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকে। কিন্তু তা আমার রোগীদের প্রতি আচরণে প্রকাশ কেন পাবে? যাঁদের সঙ্গে কাজ করি, তাঁরা যেন আমার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলার মতো ভরসা পান।’’
মনোবিদের সঙ্গে সহজ ভাবে কথা বলা যায় কি? কী বলেছিল ‘ডিয়ার জিন্দগি’-র এই দুই কেন্দ্র চরিত্র?
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন রোগী দেখার সময়ে কোনও ভাবেই নিজের পছন্দ-অপছন্দকে অগ্রাধিকার দিলে চলবে না। এর পিছনে কয়েকটি বিশেষ কারণ আছে বলে মনে করেন তিনি। অনুত্তমা বলেন, ‘‘মনোবিদের সঙ্গে রোগীর মূল্যবোধ না-ই মিলতে পারে। কিন্তু সেটিকেই প্রথমে গুরুত্ব দিলে মুশকিল। যেমন এক রোগী আসতেই পারেন যিনি তুকতাকে বিশ্বাস করেন। আমি করি না। কিন্তু প্রথমেই যদি তাঁর বিশ্বাস নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলি, তবে সেটা সমস্যার। তা হলে তিনি তো গুটিয়ে যাবেন। আর আমার সঙ্গে কথাই বলতে পারবেন না। এমন ক্ষেত্রে আমি তাঁকে বলি যে, এই তুকতাক বিষয়টি সম্পর্কে আমার তেমন স্পষ্ট ধারণা নেই। এটি বলার মধ্যে দিয়ে এই বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে একটি খোলাখুলি আলোচনার আবহ তৈরি করা যায়। এবং তাঁর মধ্যে দিয়ে কোথায় বিষয়টিতে তিনি সঙ্কটাপন্ন হচ্ছেন, সেটি বুঝে তবে তার থেকে বেরোনোর রাস্তা নিয়ে কথা বলা সম্ভব। যদি প্রথমেই আমি একটি তাত্ত্বিক প্রশ্ন তুলে বিষয়টিকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিই, তা হলে কিন্তু বাকি আলোচনাটাই আর এগতো না। সেই বিশ্বাসের জায়গাটাও স্থাপিত হত না, যা নিয়ে তিনিও আমার সঙ্গে আলোচনা এগোতে পারেন।’’
আরও অনেকগুলি দিক আছে, যা নিয়ে বিশেষ ভাবে উচিত-অনুচিতের প্রসঙ্গ ওঠে বলে মনে করান অনুত্তমা। বিশেষ করে বহুপ্রেম, পরকীয়া আর সমলিঙ্গের সম্পর্ক নিয়ে সমস্যা হয়। তিনি বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই মনোবিদ এমন কোনও পরামর্শ দেন যেখানে একটি ‘ভুল’ থেকে রোগীকে মুক্ত করছেন তিনি। কিন্তু যে মুহূর্তে রোগীর একটি পদক্ষেপকে ভুল বলে দেওয়া হল, সেখানেই সমস্যা তৈরি হয়। তাঁর ভাবনার সঙ্গে নিজের মতাদর্শের দূরত্ব স্পষ্ট করে দেওয়া হয়।’’ তিনি মনে করান, নিজের মত রোগীর উপরে আরোপ করা মোটেও মনোবিদের কাজ নয়। এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে মনোবিদকে। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে যিনি থেরাপিতে আসছেন তিনি কী ভাবে আগের তুলনায় বেশি স্বস্তিতে থাকতে পারেন, সেটা দেখাই মনোবিদের কাজ। রোগীর জীবনদর্শন যদি বদলাতে হয়, তা হলে সেটা তাঁর অন্তর্দর্শন দিয়েই বদলাতে হবে, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া মূল্যবোধ বা ঠিক-ভুলের পাহারা দিয়ে সেটা সম্পন্ন করা থেরাপিস্টের কাজ নয়।