Coffee

International Coffee Day 2021: বলো তো আরশি, কে বেশি বাঙালি? চা না কফি

চা আপন নাকি কফি, সে প্রসঙ্গ প়ড়ের। বাঙালির আরও আপন যে চা বনাম কফি নিয়ে তর্ক।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২১ ১৫:০৪
Share:

এই দুই পানীয় নিয়ে বিপ্লব কম হয়নি। আবার এঁদের মধ্যে বাঙালির কে বেশি আপন, সে তর্কের প্রদীপের তেলও ফুরোয়নি। ফাইল চিত্র।

‘এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই’। তোলপাড় করেছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির নব্বইয়ের দশক। একাদশ শ্রেণির ভাগ্নি কি না এখন সেই গান শুনে মার্কিন টানের ইংরেজিতে বলে, ‘‘চা হাতে আবার ডেটিং? ডিসগাস্টিং!’’ ষাট পেরোনো মা-বাবা তা শুনে মুচকি হাসেন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক ভাঁড় চা এখনও ভিড় রাস্তায় একা করে দেয় দু’জনকে। শীত শুরুর কোনও ফুরফুরে সন্ধ্যায় নাটক দেখে ফেরার আগে এক কাপ চা বাদ পড়ে না এখনও রুটিন থেকে। আবার সেই নাটক নিয়ে চর্চা কিন্তু হয় কফি হাউসে বসেই। কফি হাউসের রোমান্টিকতাও যে চায়ের ভাঁড়ের মতোই আপন। অতি বাঙালি। তার সঙ্গে জড়িয়ে কত ইতিহাস।

Advertisement

চা বনাম কফি বিতর্কও তাই তর্কবাগীশ বাঙালির আপন। এই দুই পানীয় নিয়ে বিপ্লব কম হয়নি। আবার এদের মধ্যে বাঙালির কে বেশি আপন, সে তর্কের প্রদীপের তেলও ফুরোয়নি। পাড়ার চায়ের দোকানের কালচে সসপ্যানে দিব্যি ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছে কফি। ভাঁড় হাতে আড্ডায় মাঝেমধ্যে ঢুকে পড়ে চা-ফিও। তবু বাঙালি তো তর্কে বহু দূর!

Advertisement

সুমন চাটুজ্জ্যে যত দিনে তুলেছিলেন এক কাপের চায়ের প্রসঙ্গ, তত দিনে মধ্যবিত্তের প্রেম বন্ধুত্ব আড্ডা বিপ্লব কথা কাটাকাটি— সর্ব ঘটেই সসম্মানে উপস্থিত অতি আহ্লাদের সেই ধোঁয়া ওঠা পেয়ালা। এমনকি, জমজমাট গেরস্থালির এক কোণে কত্তা-গিন্নির একান্ত সময়টুকুতেও ভাগ বসাতে স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছে এক কালের প্রায় নিষিদ্ধ সেই পানীয়।

চা আবার নিষিদ্ধ কিসের?

সুমনের সেই গান শুনলে ১৯ শতকের কত কাকিমা-মাসিমা যে হায় হায় করতেন, কে জানে! রবিঠাকুরের ‘চোখের বালি’র মা-পিসিমার চা পানের কথা মনে পড়ে? দুপুরবেলা সক্কলে যার যার ঘরে জিরোতে গেলে তবে দরজা বন্ধ করে, চুপিচুপি বসত আড্ডা। মহিলারা এমনিতেই চা খেতেন না সে সময়ে। আর পুরুষদের উপস্থিতিতে তো প্রশ্নই ওঠে না। তা তিনি নিজের স্বামীই হোন না কেন। প্রেমে-ভালবাসায় আবার চা কিসের? তার সঙ্গে তো ছিল পান-সুপুরির সম্পর্ক। খাওয়ার পরে স্ত্রীর হাতে সাজা একটি পান, তাতেই তো যত আহ্লাদ।

অতিথি আপ্যায়নেও তাই। বাঙালি বাড়িতে অতিথি এলেই বেরিয়ে পড়ত পানের বাটা। বাড়িতে কেউ আসা মাত্র ‘চা না কফি’, এ প্রশ্ন স্বাভাবিক ছিল না গত শতকের শুরুর দিকেও। আর হবেই বা কেন? নিজেরা লুকিয়ে লুকিয়ে যদি বা কেউ ‘ম্লেচ্ছদের’ এ সব বদ অভ্যাসে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন, তাই বলে কি তাঁর পরিবারের কোনও সম্মান থাকতে নেই? সমাজে মান রাখতে চায়ের পেয়ালা অন্দরমহলেই থাকত। ঠিক যেমন বছর দশেক আগেও পাশের বাড়ির বৌদি হঠাৎ কলিং বেল বাজালে, গৃহকর্তা হুইস্কির বোতলটি কোথায় লুকাবেন বুঝতে পারতেন না, অপ্রস্তুত হয়ে পড়তেন গিন্নিও। চায়ের সামাজিক অবস্থানও খানিক তেমন ছিল এক কালে।

বিশ্বজুড়ে বহু যুদ্ধের পরে তবে কি না চা ফিরেছে নিজের দেশে, বিজয়ীর বেশে। ফাইল চিত্র।

কুয়াশা মাখা ভোরে ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাস কামরায় সপরিবার জানলার ফাঁক দিয়ে হাত বার করে এক ভাঁড় দুধ-চিনি মেশানো ‘চা গরম, গরম চা’ দিয়ে যে মোটেও তার পথ চলা শুরু নয়। বিশ শতকের গোড়াতেও সে ছিল অভিজাত বাড়ির নিষিদ্ধ আড্ডার রসদ। সাহেবদের দেখে ‘বড়লোক বাড়ির বখে যাওয়ারা’ এ সব খেতেন মাঝেমধ্যে।

শোনা যায়, একটি মঠের সন্ন্যাসীদের বহু দিন ভাল চোখে দেখতেন না স্থানীয়েরা। মাঝেমধ্যেই কটূক্তি ভেসে আসত। ‘এঁরা আবার সন্ন্যাসী নাকি? ম্লেচ্ছদের মতো চা-কফি খান!’

সেই ‘ম্লেচ্ছদেরও’ কিন্তু সহজ ছিল না চা পানের পথ। বিলেতে ন্যাশনাল ড্রিঙ্ক হয়ে ওঠা চা অথবা টি-কে এক কালে যথেষ্ট লড়াই করতে হয়েছে সমাজে নিজের জায়গা করে নিতে। অর্থাৎ, বিশ্বজুড়ে বহু যুদ্ধের পরে তবে কি না চা ফিরেছে নিজের দেশে, বিজয়ীর বেশে। তা-ও ভিন্ দেশিদের হাত ধরে।

লড়াই অবশ্য থামেনি। চলছে বললেই ভাল হয় বরং। শুধু সমাজের সঙ্গে নয়। কফির সঙ্গেও। সে যুদ্ধ শুরু কোম্পানির আমলেরও আগে। যখন সবে চা ঢুকেছে বিলেতে, এ মহাদেশে ঘুরে যাওয়া কিছু ব্যবসায়ীর হাত ধরে। আগুন দাম তখন বিলেতের বাজারে। তবু কয়েক দিনেই চরম জনপ্রিয় হয়ে উঠল। স্বমহিমায় জায়গা করে নিল বিভিন্ন কফি হাউজের মেনুতেও। ব্যস শুরু হয়ে গেল বিতর্ক, যা থামেনি আজও।

কিন্তু কার পাল্লা বেশি ভারী, চা না কফি?

এ প্রসঙ্গে আব্রাহাম লিঙ্কনের এক অসাধারণ উক্তি মনে পড়বে অনেকের। এক পেয়ালা গরম পানীয় দেখে না কি লিঙ্কন এক বার বলেছিলেন, ‘‘এর আগে যদি আমাকে চা দিয়ে থাকেন, তা হলে এ বার কফি দিন। আর আগেরটা যদি কফি হয়ে থাকে, তবে চা দিন।’’ অনেক বাঙালির মনের অবস্থাও তেমনই। স্বয়ং রবিঠাকুরের অভিজ্ঞতাই ধরা যাক। শান্তিনিকেতনে চা-চক্র চালু হবে। সপ্তাহে এক দিন করে বিকেলে বসবে আসর। গুরুদেবের সঙ্গে দেশ-দশকে নিয়ে নানা ভাবনা আলোচনা করতে আসবেন বিশিষ্টজনেরা। প্রথম দিনের আড্ডা জমানোর জন্য এই গান লিখে ফেললেন রবিঠাকুর। ‘‘হায় হায় হায় দিন চলি যায়। চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চলো চলো চলো হে। টগবগ-উচ্ছল কাথলিতল-জল কলকল হে…’’

রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট চা বিলাসী ছিলেন বলেই শোনা যায়। পছন্দ ছিল চিনা ফ্লেভার। চাই গ্রিন টি কিংবা জ্যাসমিন চা। তবে তাতে মিশবে প্রচুর পরিমাণ দুধ-চিনি। যা শুনে এ প্রজন্মের চা-প্রেমীরা হায় হায় করবেন হয়তো।

বাঙালির ঘরে ঘরে চা চর্চা জোরাল করেছে কড়া লিকার হওয়ার গুঁড়ো চা। দুধ-চিনি মিশিয়ে যা হবে একটি ভরপুর ব্যাপার। দামও অবশ্যই অনেক অনেক কম।   ফাইল চিত্র।

শান্তিনিকেতনের নানা গল্পে উঠে আসে, কয়েকটা চা পাতা অল্প জলে দিয়ে একটু ফুটিয়ে কাপে ঢেলে নিতেন রবীন্দ্রনাথ। বাকি কাপটি ভরতেন দুধ-চিনিতে। অভ্যাস ছিল কফিরও, বানানো হত একই কায়দায়। অল্প ঘুমিয়ে নিয়ে আবার কাজে বসার আগে রোজ দুপুর দু’টো নাগাদ অনেকটা দুধ আর চিনি দেওয়া এক কাপ কফি খেতেন তিনি। এ ভাবে কেন কফি খাওয়া জিজ্ঞেস করলেই না কি বলতেন, সকলেরই তো কথা রাখতে হবে। মহাত্মা গাঁধী তাঁকে বলেছিলেন, প্রয়োজনীয় ঘুমটুকু যেন হয়। আবার বউমা প্রতিমাদেবী শ্বশুরমশাইকে বলেছিলেন, একটু করে কফি খেতে। অথচ কফি খেলে ঘুম আসবে না। আর ঘুমোতে চাইলে কফি খাওয়া উচিত নয়! তাই যাতে কফি খাওয়া হয় এবং ঘুমও আসে, দু’দিক রক্ষা করতে নাকি অল্প কফিতে এত্তটা দুধ মিশিয়ে ফেলতেন রবিঠাকুর।

তবে কি বলা যায়, চা-কফি নিয়ে বাঙালির পিটপিটানি খানিক কেটেছে রবিঠাকুরের হাত ধরেও? রবীন্দ্রনাথ ছাড়পত্র দিলে যে অনেক পাপই কাটে বাঙালির, তা তো অবশ্যই আলোচনার ঊর্ধ্বে। তবে বাঙালির চা প্রেমে আরও একটি বড় অবদান আছে। তা হল বিশ শতকের গোড়ায় সিটিসি আবিষ্কার। দার্জিলিঙের ফার্স্ট ফ্লাশ নিয়ে আদিখ্যেতা যতই থাকুক না কেন, বাঙালির ঘরে ঘরে চা চর্চা জোরাল করেছে এই কড়া লিকার হওয়ার গুঁড়ো চা। দুধ-চিনি মিশিয়ে যা হবে একটি ভরপুর ব্যাপার। দামও অবশ্যই অনেক অনেক কম।

আর কফি? তাতেও মিলেমিশে আছে অনেক ইতিহাস। বাঙালির নিষিদ্ধ প্রেম নিষিদ্ধ বিপ্লবে আর এক নিষিদ্ধ সঙ্গী কফিও বটে। তাই আপন কে বেশি, সে তর্ক নেহাত অপ্রাসঙ্গিক নয়। তা হলে মোকা, লাতে, ফ্রাপে? এ সব কি আপন? সত্তর ছুঁই ছুঁই দিদিমার এখন সে সব কায়দা মন্দ লাগে না। কিন্তু চা-কফির সঙ্গে আড্ডাটাই যে আসল। কফি হাউসে গিয়ে বসলেই হল। তাতে মোকা, লাতে না-ই বা থাকুক। ছোট্ট কাপে ধোঁয়া ওঠা কালচে পানীয়ের টান অন্য। ইনফিউশন ছলকে যাওয়ার কথা তো এ যুগের তরুণরাও গানে গানে মনে করান। আর যেই না এসে গেল ইনস্ট্যান্ট কফি, সঙ্গে সঙ্গে সেই কালো তরল ঢুকল ঘরোয়া আড্ডাতেও।

তাই বলে যে কলকাতার কফি মানেই কফি হাউস, বা কফি হাউস মানেই কলকাতা, এমন দাবি একটু বাড়াবা়ড়ি হয়ে যায়। কফি কলকাতায় এল কোথা থেকে, তা জানা জরুরি। কফি বেশি ভারতীয়, তা অনেকেই বলে থাকেন। তবে বাঙালি হতে সময় লেগেছে অনেকটাই।

কফি হাউসের কোল্ড কফি যতই নাম করক না কেন, আধুনিক কফি চেনের দৌলতে বাংলায় কফির স্বাদ ইনফিউশন ছাপিয়ে মোকা, লাতের দিকে এগিয়েছে। ফাইল চিত্র।

কেউ বলেন দক্ষিণের ‘কাপি’ই বাঙালির কফির অনেক আগে থেকে প্রচলিত। সে দিকের ব্যবসায়ীরা যত কলকাতা ও হাওড়ায় নানা জিনিসের ব্যবসা নিয়ে আসেন, তাঁদের হাত ধরে শুরু হয় এ শহরের বিভিন্ন ‘মাদ্রাজ কাফে’। সেখানেই মূলত কফি খাওয়ার প্রচলন দেখতে শেখে বাঙালি।

তবে সে সব কথা আজ বলা বৃথা। সংস্কৃতি সচেতন বাঙালি কি আগে মাদ্রাজ কাফের কথা বলবে, নাকি প্রিয়া কাফের গান ধরবে? বলাই বাহুল্য, দ্বিতীয়টির চলই বেশি। তবে একটি কথা না মেনে উপায় নেই, কফি হাউস সংস্কৃতির পীঠস্থান না হয়ে উঠলে বাঙালি বাড়িতে চায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে জায়গা করে নেওয়া কফির পক্ষে সহজ হত না।

হালের নব্বইয়ের দশকেও বোধ হয় কফি আর কফি হাউস প্রসঙ্গ এ শহরে একই ছিল। সত্তরের দশকে বিখ্যাত এক বাঙালি কবির বাড়িতে নাকি নিত্য অশান্তি লেগেই থাকত। কারণ বাড়ির চার ছেলের মধ্যে তিন জনই সারা সন্ধ্যা বসে থাকতেন কফি হাউসে। মায়ের মুখ ভার। ছেলেরা বুঝি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেলেন। তার পর এক দিন শোনা গেল সেখানে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকরাও আসেন। এ বার বিপদ বাড়ল। তবে তো রাগ করা যায় না। কিন্তু কেউ কফির প্রসঙ্গ তুললেই মান হয় মায়ের। কারণ কফি হাউসের কথা মনে পড়ে যায়।

তবে এ যুগের মায়েরা কফি হাউস নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না। করলে করেন কিছু কাফে নিয়ে। কফি হাউসের কোল্ড কফি যতই নাম করক না কেন, আধুনিক কফি চেনের দৌলতে বাংলায় কফির স্বাদ ইনফিউশন ছাপিয়ে মোকা, লাতের দিকে এগিয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement