Coffee

International Coffee Day 2021: বিশ্ব কফি দিবস: কফি হাউস কোনও অনড় প্রতিষ্ঠান নয়, এক বহমান স্রোতধারা

কফি হাউসের সেই আড্ডা আজ আছে না নেই? ‘আন্তর্জাতিক কফি দিবস’-এ ফিরে দেখা যাক কলকাতার সাংস্কৃতিক জগৎ ও কফির সম্পর্ক।

Advertisement

সব্যসাচী দেব

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২১ ১১:৩৯
Share:

কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস। ফাইল চিত্র।

অ্যালবার্ট হল কফি হাউস হয়ে উঠেছিল বোধহয় ১৯৪২-এ। তখন কি কলকাতায় আর কোনও এ রকম কফিখানা ছিল! জানা নেই। কফি হাউসের নামটা শোনা ছিল আগেই, প্রথম সেখানে ঢুকলাম ১৯৬২-তে। কলেজ স্ট্রিট তো সিটি কলেজের কাছেই, কিছু ক্ষণ কলেজ স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে উল্টো দিকের ভাঙা সিনেট হল দেখে এসে ঢুকেছিলাম কফি হাউসে। সেই প্রথম মধ্যবিত্ত পরিবারের এক তরুণের কফিতে চুমুক দেওয়া।

Advertisement

প্রথম কফির স্বাদ ভাল লাগেনি, কিন্তু প্রথম পরিচয়েই কফি হাউস মন ভরিয়ে দিল। সে দিনই ঠিক করেছিলাম আবার আসব। তার পর কাটল ৫৯ বছর, আজও তাকে ছাড়তে পারিনি। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফি হাউসে এক বারই ঢুকেছিলাম। শ্যামবাজারেও ছিল কফি হাউস, পাঁচ মাথার মোড়ের খুব কাছেই, পরে সেখানেই হরলালকার শোরুম হয়েছিল। সেই কফি হাউসেও গিয়েছি কয়েক বার, বিনয় মজুমদারকে প্রায়ই দেখা যেত সেখানে। যাদবপুর কফি হাউসে ঢুঁ মেরেছি দু’-তিন বার। প্রথম কলেজের চাকরির সুবাদে কয়েক মাস ছিলাম ত্রিপুরার বিলোনিয়ায়, সেই ছোট্ট শহরেও ছিল একটি আট-দশ জন বসার মতো কফি হাউস। কফিও বানাত খুব ভাল, আমাদের প্রবাস-সন্ধ্যা কাটত সেখানে। এক বার ঢুকেছিলাম শিমলার কফি হাউসে। পানীয় বা পরিবেশ কোনওটিই মন টানেনি। শেষ পর্যন্ত কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসই রয়ে গেল আমার ভালবাসা হয়ে।

এখন শহরে অনেক কফিখানা, তাদের পরিবেশে আছে চোখ-ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, আছে শান্ত পরিবেশের দাঁতচাপা ভদ্রতা। কফির কত ঘরানার খবর রাখে আজকের প্রজন্ম। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে পুরনো বাড়ির গন্ধ লেগে আছে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হাঁপ ধরে, ভিতরে প্রবল হট্টগোল, কফির স্বাদ জোলো, খাবার খুব উঁচু মানের নয়। কিন্তু তার আছে এক দৃপ্ত আভিজাত্য। খাবারের মান নিয়ে কোনও দিনও মাথা ঘামাইনি, কারণ ওখানে খেতে যেতাম না, যেতাম আধ কাপ কফি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক অদ্ভুত নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে।

Advertisement

এখন শহরে অনেক কফিখানা, তাদের পরিবেশে আছে চোখ-ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য, আছে শান্ত পরিবেশের দাঁতচাপা ভদ্রতা। ফাইল চিত্র।

কফি হাউস কেন মন টেনেছিল, এখনো টানে! আড্ডার জন্য সময়ের কোনও বাঁধন ছিল না, অল্প বয়সে সেটি ছিল এক বড় কারণ। তার থেকেও বড় কারণ বোধ হয় ছিল নিজেদের একটি ঐতিহ্যের অংশ ও উত্তরাধিকারী ভাবার গৌরববোধ। সারা কলকাতার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের সেরা মানুষেরা যেখানে এসে জড়ো হন, তাঁদের পাশের টেবিলেই হয়তো বসছি আমরা, এই ব্যাপারটিকে একটি বড় পাওয়া মনে হত। সত্যজিৎ রায়কে এক বারই দেখেছিলাম এখানে, খুব অল্প সময়ই ছিলেন। ঋত্বিক ঘটককে পাইনি কখনও। কিন্তু মৃণাল সেনকে বেশ কয়েক বার দেখেছি। তখন অবশ্য তিনি আমার কাছে দূরের নক্ষত্র, মৃণালদা হয়ে ওঠেননি। আমরা যুবক হয়ে উঠছিলাম যাঁকে দেখে সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কখনও ঢোকার মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ঢোলা পায়জামা, পাঞ্জাবি পরে, কাঁধে ঝোলা, কখনও বা আমাদের পাশের টেবিলে। দু’-এক বার দেখেছি শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কেও। সৌমিত্রর টেবিলে নির্মাল্য আচার্য, কখনও শক্তি চট্টোপাধ্যায়। পরে দেখেছি এখানে বসেই নির্মাল্য ‘এক্ষণ’-এর প্রুফ দেখছেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় সেই ষাট দশকের বছরগুলিতে নিয়মিতই আসতেন কফি হাউসে। আমরা

কাছে ঘেঁষার সাহস পেতাম না, তবু ছাত্র জীবনের উৎসাহে পত্রিকা বার করে তাঁদের কাছে লেখা চেয়েছি কয়েক বার। কফি হাউসের বাইরে অন্য কোথাও তাঁদের দেখা পাব এমনটি মনেই হত না। শঙ্খ ঘোষ তখন কমই আসতেন। এক বার তিনি আর অলোকরঞ্জন একসঙ্গে এসেছিলেন। একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল সে দিন। প্রায় দু’মাস আগে দীপক মজুমদারের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল, তিনি ওই দিন কফি হাউসে আসতে বলেছিলেন। আমি তখন নিয়মিত যাই, কাজেই আমার সমস্যা ছিল না। কিন্তু দীপক কি দু’মাস আগের কথা মনে রাখবেন! তা ছাড়া উনি আমাকে কখনও দেখেননি, আমিও না; চিনবেন কী করে! কথাটা শঙ্খবাবুকে বলতেই তিনি বলেছিলেন চিন্তা কোরো না, দীপক তো, ও ঠিক চিনে নেবে। ঘটেও ছিল তাই। আমাদের টেবিলের সামনে এসেই দীপক আমাকে চিনে নিলেন। এটি অবশ্য অনেক পরের, সত্তরের দশকের শেষ দিকের ঘটনা।

তুষার রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এই কফি হাউসেই। তখন তুষারের দাপুটে উপস্থিতি, পরে এখানেই তুষারের বিধ্বস্ত চেহারাও দেখেছি। শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায় আসতেন প্রায়ই, খুব ঘনিষ্ঠ না হলেও তাঁর টেবিলে বসেছি বেশ কয়েক বার। বন্ধু রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কেটেছে কত দিন। কফি হাউসের একটি পরিচিতি তো নকশালপন্থীদের আড্ডাখানা হিসাবেও। প্রেসিডেন্সির ছাত্র-আন্দোলনের সময়ে এক সন্ধ্যায় ফাঁকা পেয়ে অসীম চট্টোপাধ্যায়ের কাছে বিনীত ছাত্রের মতো কত প্রশ্ন তুলেছিলাম মনে পড়ে। আরও কত জন, এলোমেলো কিছু উল্লেখ করলাম শুধু।

কো-অপারেটিভ হওয়ার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে জমা হয়েছিলাম নানা প্রজন্মের মানুষেরা, শঙ্খ ঘোষ, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে তরুণতররা। সে দিন টের পেয়েছিলাম কফি হাউস কোনও অনড় প্রতিষ্ঠান নয়, এক বহমান স্রোতধারা।

১৯৬২-তে কফি হাউসে যাওয়া শুরু, করোনা-কালেও দু’-তিন বার গিয়েছি। এই উনষাট বছরে আড্ডার সঙ্গী বদলেছে, কফির দাম পঞ্চাশ পয়সা থেকে বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছে আটটাকায়। ফাইল চিত্র।

কফি হাউস খাওয়ার জায়গা নয়, বিস্বাদ কফিতে চুমুক দিয়ে নির্ভেজাল আড্ডার জায়গা। সে আড্ডায় পরনিন্দা পরচর্চা হয়, কিন্তু নামে না কুৎসার স্তরে। সাহিত্য সিনেমা নাটক ছবি গান আর রাজনীতি জড়িয়ে যায় একসঙ্গে, তর্কে উত্তাপ বাড়ে, যদিও তা ক্ষণস্থায়ী। কফি হাউসে বসেই লেখা হয়েছে বন্ধুদের কত পঙক্তি, জন্ম নিয়েছে কত ভাবনা।

১৯৬২-তে কফি হাউসে যাওয়া শুরু, করোনা-কালেও দু’-তিন বার গিয়েছি। এই উনষাট বছরে আড্ডার সঙ্গী বদলেছে, কফির দাম পঞ্চাশ পয়সা থেকে বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছে আটটাকায়। সে-দামটাও এখন কলকাতার কাফের ভোক্তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। চেয়ারগুলি বদলেছে, দেয়ালে রং করার পর নানা ছবিতে সাজানো, সিঁড়িতে বয়স্কদের জন্য লাগানো হয়েছে টানা হাতল। বদলেছে খাবার, চাওমিনও ঢুকে পড়েছে তালিকায়। নিয়মিত ভিড় ছাড়াও ভিড় জমায় মরশুমি লোকজন, বিশেষ করে পুজোর আগে। ঢাউস ব্যাগে শাড়ি ফ্রক শার্ট পাঞ্জাবি ভরে কর্তা গিন্নি সপুত্রকন্যা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে আসেন সিঁড়ি বেয়ে, তাঁদের কাছে এটি একটি রেস্তরাঁ ছাড়া আর কিছু নয়।

এখনও তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় আধ কাপ ইনফিউসন নিয়েই। ফাইল চিত্র।

আমরাও বদলেছি। শুরুর দিনগুলিতে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমত, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে বন্ধুদের সঙ্গে জুড়ল বান্ধবীরা। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর নানা ধরনের বন্ধু, কবি লেখক শিল্পী সম্পাদক। তার পর রাজনীতি ও গণ-আন্দোলনের বন্ধুরা। ধরন পুরো কি বদলায়! এখনও তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় আধ কাপ ইনফিউসন নিয়েই। কথা গড়াতে থাকে সিরিয়াস থেকে হাল্কায়, আবার ফিরে যায় অন্য কোনও প্রসঙ্গে, বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাতে, দরজা আর্ধেক বন্ধ করে কর্মচারীরা জানান দেন, আজকের পালা শেষ, বেরোবার মুখেও অন্য টেবিলের পরিচিতদের সঙ্গে কিছু হাসি কিছু কথা বিনিময়।

পাল্টেছে একটি ব্যাপার। আগে নিজের টেবিল ছেড়ে অন্য টেবিলে দেখা করতে যেতাম পরিচিতদের সঙ্গে, এখন বয়সের দাবিতে অন্যরাই আসে আমাদের টেবিলের কাছে। কফি হাউস একই সঙ্গে আমার, আমাদের নস্টালজিয়া আর ঘটতে-থাকা বর্তমান।

(লেখক কবি ও অধ্যাপক।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement