ঘুমের অভাবে ক্লান্তি, অবসাদ গ্রাস করছে।
দৈনন্দিন জীবনযাপন ও কাজের ধারায় স্লিপ সাইকল বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই মুশকিল। কখনও রাত করে বাড়ি ফেরা, কখনও টার্গেট রিচ করতে অর্ধেক রাত জেগে কাজ শেষ করা আবার কারও রয়েছে শিফ্টিং ডিউটি। সব মিলিয়ে ঘুমের সময় রোজই বদলাচ্ছে। কিন্তু শরীরের ঘড়ি কি অত দ্রুত সময় পাল্টাতে পারছে? ফলে ঘুমের অভাবে ক্লান্তি, অবসাদ গ্রাস করছে।
সমস্যা কোথায়?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় বললেন, “একজন মানুষের প্রত্যেক দিন ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুম দরকার। ঘুমের প্রধান কাজ হল হোমিয়োস্ট্যাসিস। অর্থাৎ ঘুমের সময়ে শরীর শুধু বিশ্রামেই থাকে না, পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ঘুমের সময়ে মস্তিষ্কের কিছু অংশে সির্কাডিয়ান রিদম মডারেটেড হয়। যেমন মেলাটোনিন হরমোন অন্ধকারে নিঃসৃত হয়। দিনের বেলায় উজ্জ্বল আলোয় মেলাটোনিন ক্ষরণ কমে যায়। সূর্যাস্তের পরে অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই হরমোন ক্ষরণ বাড়তে থাকে। কিন্তু এখন আমরা সন্ধেবেলা আলো জ্বালিয়ে বসে থাকি। রাত পর্যন্ত চলে, ল্যাপটপ, টিভি, মোবাইল। এখন বই হাতে নিয়ে পড়ার অভ্যেসও চলে গিয়েছে। পিডিএফ বা কিন্ডলে বই পড়া, অনলাইনে পড়ার অভ্যেস বাড়ছে। এই স্ক্রিন থেকে যে আলো বেরোচ্ছে, তা আমাদের শরীর থেকে স্বাভাবিক ভাবে মেলাটোনিন হরমোন ক্ষরণে বাধা দিচ্ছে।”
প্রত্যেক রাতে ঘুমোনোর সময়ে আমরা ৫-৬টি স্লিপ সাইকল সম্পূর্ণ করি। এর মধ্যে রেম (আরইএম অর্থাৎ র্যাপিড আই মুভমেন্ট) ও এনআরইএম অর্থাৎ নন-র্যাপিড আই মুভমেন্টের ভাগ রয়েছে। “রেম স্লিপে মানুষ বেশি স্বপ্ন দেখে। এই রেম স্লিপের সময়টা আসে সকালের দিকে। অন্য দিকে নন-রেম স্লিপের স্মৃতি থাকে না। এই নন-রেম স্লিপের আবার তিন ও চার নম্বর স্টেজকে বলে স্লো-ওয়েভ স্লিপ। এই স্টেজে ঘুমের কোয়ালিটি খারাপ হলে ঘুম ভাল হয় না। তখন কিছু কিছু সাইকিয়াট্রিক ডিজ়অর্ডার দেখা যেতে পারে,” বলে জানালেন ডা. আবীর মুখোপাধ্যায়।
শিফ্টিং ডিউটিতে এই স্লিপ সাইকল সম্পূর্ণ না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নাইট শিফট যদি নিয়মিত হয়, সে ক্ষেত্রে দিনের কোনও একটা সময়ে ঘুমের অভ্যেস থাকলে ঘুমের অভাব হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেউ যদি দু’দিন নাইট শিফট করে আবার একদিন ডে শিফ্ট আবার দু’দিন নাইট শিফ্টে কাজ করেন, তখন কিন্তু তাঁর ঘুমে বিঘ্ন ঘটবে। এত বার সময় বদলালে শরীর কিন্তু সেটা বুঝতে পারবে না। দু’-তিন দিন ধরে দিনে ঘুমোনোর অভ্যেস হয়ে গেলে তার যদি পরের দিন ডে শিফ্ট থাকে, তার রাতে ঘুম আসতে চাইবে না। উল্টে কাজের সময়ে হয়তো ঘুম পাবে। তাই স্লিপ সাইকলে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আবার কাজের সূত্রে অনেকেই নিয়মিত ট্রাভেল করেন। প্রতি সপ্তাহেই হয়তো এক বার রাজ্য বা দেশের বাইরে যাচ্ছেন, ফিরছেন। তাঁদেরও জেট ল্যাগ থাকে। সে ক্ষেত্রে বাড়ি ফিরেই কাজ শুরু না করে তখন পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। এতে পরবর্তী কাজে মনঃসংযোগ বাড়বে, কাজও ভাল হবে।
কাজের ক্ষেত্র বাদ দিলেও এখন ডিজিটাল লাইফ বেড়ে যাওয়ার জন্যও স্লিপ সাইকল বিঘ্নিত হচ্ছে। হয়তো একজন সন্ধেবেলা কাজ সেরে বাড়ি ফিরছেন। তার পরে বিশ্রাম নিয়ে খেয়েদেয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু অনেকেই তা না করে মাঝরাত পর্যন্ত সিরিজ় দেখেন বা সোশ্যাল সাইট স্ক্রল করেন। এতে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে যায়। একটা সময় পরে ফোন অফ করে ঘুমোতে চাইলেও ঘুম আসতে চায় না। ঘুম বিঘ্নিত হলে কিন্তু শারীরিক সমস্যাও বাড়তে থাকে। দীর্ঘদিন রাত জেগে স্ক্রিনটাইম বাড়াতে থাকলে শরীরের বন্ধু হরমোনের ক্ষরণ কমে যায়। ফলে বিভিন্ন রোগবালাই ঘিরে ধরে। ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যাওয়ার ঘটনা খুব কমন। এ ছাড়াও হরমোনাল সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে পারে। স্নায়ুর রোগ দেখা দিতে পারে। দীর্ঘদিন ভাল ঘুম না হলে অবসাদও গ্রাস করে।
সমাধান কী?
* সন্ধের পরে চা-কফি খাওয়ার অভ্যেস ত্যাগ করতে হবে। ছাড়তে হবে ধূমপানও। ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় বললেন, “আর-একটা বিষয়ও খুব জরুরি, সেটা হল শারীরচর্চা। এখন শিশু থেকে শুরু করে বড়দের মধ্যেও ফিজ়িক্যাল অ্যাক্টিভিটি অনেক কমে গিয়েছে। খেলাধুলোর চল সে ভাবে নেই। বিকেলে এক ঘণ্টা যদি কোনও ঘামঝরানো খেলায় যুক্ত থাকা যায়, তা হলে ভাল। ক্রিকেট, ফুটবল, সাঁতার যে-কোনও অ্যাক্টিভিটি বেছে নিতে পারেন। শারীরিক ক্লান্তি থাকলে ঘুমও আসবে তাড়াতাড়ি।”
* ঘুমোতে যাওয়ার দেড় ঘণ্টা আগে ডিনার সেরে ফেলতে হবে।
* ঘুমোনোর আগে মোবাইল, ল্যাপটপ... কোনও স্ক্রিন দেখবেন না। সে সময়ে হাল্কা গান শুনতে বা বই পড়তে পারেন। সব আলো নিভিয়ে অন্ধকারে ঘুমোলে ভাল।
রোজ নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমোতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস করা জরুরি। এতে স্লিপ সাইকলে বিঘ্ন ঘটে না। পর্যাপ্ত ঘুম হলে মস্তিষ্ক কাজও করে ঠিক ভাবে।