‘শ্যানেল’এর নতুন সিইও লীনা নায়ার । ছবি: সংগৃহীত
কোনও বি-স্কুলের পাঠক্রমে ‘নেতৃত্বের’ যে সংজ্ঞা লেখা থাকে, তার চেয়ে অনেকটাই অন্য রকম ‘শ্যানেল’-এর নতুন সিইও লীনা নায়ার। কারণ তিনি মানুষকে বুঝতে পারেন। যে কোনও পরিস্থিতিতে মানুষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে পারতেন। তাই সহজেই সব রকম প্রতিকূলতাই জয় করতে পারতেন। সেই কারণেই তাঁর আজকের সাফল্যে খুব একটা চমকে যাননি তাঁর প্রাক্তন প্রশিক্ষক অনিরুদ্ধ লাহিড়ী।
‘পেপসিকো’-র ইন্দ্রা নুয়ির পর লীনা দ্বিতীয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহিলা, যিনি কোনও সংস্থার বিশ্বস্তরে শীর্ষপদের দায়িত্ব পেয়েছেন। ৫২ বছর বয়সি লীনা ব্রিটেনের নাগরিক হলেও তাঁর জন্ম কোলহাপুরে। পড়াশোনাও ভারতেই। জামশেদপুরের এক্সএলআরআই থেকে পাশ করার পর তিনি শিক্ষনবিশ হিসাবে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ‘হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড’-এ। সেই সময়ে সেখানকার মানবসম্পদ বিভাগের অধিকর্তা ছিলেন অনিরুদ্ধ লাহিড়ী। নতুন প্রতিভাবান শিক্ষানবিশদের সংস্থায় নিয়োগ করার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। লীনাকে তখন দেখেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, শুধু মানবসম্পদ বিভাগের জন্যই নয়, এই মেয়ে আরও বড় জায়গায় কাজ করার জন্য উপযোগী।
লীনার প্রসঙ্গে অনিরুদ্ধ বললেন, ‘‘সেই সময়ে ভারতের আরও এক নাম করা সংস্থার চাকরির অফার ছিল লীনার কাছে। তাই ও খানিক দ্বিধায় ছিল কোন চাকরিটা নেবে। কিন্তু আমার ওকে দারুণ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। তাই নিজে ফোন করে ওকে বোঝাই আমাদের সংস্থায় যোগ দিতে।’’ অনিরুদ্ধ শুধু নিয়োগই করেননি। তাঁর হাত ধরেই লীনার অনেক দূর এগনো। প্রশিক্ষণের দায়িত্বেও ছিলেন অনিরুদ্ধই। সেই সময়ে কোনও কারখানার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মেয়েদের কখনওই পাঠানো হত না। কর্মী সংগঠনের নানা সমস্যা লেগেই থাকত প্রায় সব কারখানাতেই। কিন্তু অনিরুদ্ধই ঠিক করেছিলেন, লীনাকে পাঠানো হবে। তাতে লীনার অবশ্য কোনও রকম সমস্যা হয়নি। মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ তাঁর এতই ভাল যে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানেও দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন লীনা। নিজের পছন্দের প্রটেজির গল্প বলতে গিয়ে দারুণ আপ্লুত হয়ে পড়লেন এখন অবসরপ্রাপ্ত অনিরুদ্ধ।
শুধু আপ্লুত নয়, তিনি লীনাকে নিয়ে গর্বিতও বটে। ফ্যাশন দুনিয়ার শীর্ষে থাকা অন্যতম লাক্সারি ব্র্যান্ড ‘শ্যানেল’। তাঁর সিইও হওয়ার জন্য এই প্রথম কোনও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহিলাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। যাঁকে বি-স্কুল থেকে বেছে নিয়েছিলেন অনিরুদ্ধ নিজে। সে কথা অবশ্য ভোলেননি লীনাও। নতুন চাকরির অফার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কথা বলেছেন প্রাক্তন প্রশিক্ষকের সঙ্গে। জানিয়েছেন, সেই অনভিজ্ঞ মেয়েটিকে বি-স্কুল থেকে বেছে সব কাজ শেখানোর জন্য তিনি কতটা কৃতজ্ঞ। তবে শুধু চাকরিতে নিয়োগ করাই নয়, ‘হিন্দুস্তান ইউনিলিভার’-এর বোর্ড অব ডিরেক্টর্সে প্রথম কোনও মহিলা সদস্যকে রাখার পিছনেও অবদান ছিল অনিরুদ্ধর। সেই মহিলা ছিলেন লীনাই। ‘ইউনিলিভার’-এর খাস দফতর লন্ডন চলে যাওয়ার আগে এই কাজটি সেরে গিয়েছিলেন অনিরুদ্ধ।
পরে অবশ্য ‘ইউনিলিভার’-এর মানবসম্পদ দফতরের সবচেয়ে কমবয়সি শীর্ষকর্ত্রী হয়েছিলেন লীনা। তাঁর বাস তখন থেকেই লন্ডনে। তাঁর দুই ছেলে এখন থাকেন আমেরিকায়।
ফ্যাশন দুনিয়ায় তাঁর তেমন কোনও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও এত বড় একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সিইও হয়ে গেলেন লীনা। এতে অবাক হননি অনিরুদ্ধ? প্রশ্নের উত্তর দিতে একটু দেরি করলেন না লীনার ‘মেন্টর’। ‘‘একদমই না। ফ্যাশন নিয়ে কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও একটি ক্রেতা-নির্ভর সংস্থার বোর্ডে ছিল লীনা। ক্রেতাদের চাহিদা বোঝা এবং তৈরি করা— দু’টি ক্ষেত্রেই দারুণ পারদর্শী ও। তাই এই কাজ ভালই পারবে বলে আমি নিশ্চিত,’’ জবাব দিলেন অনিরুদ্ধ। তবে তিনি যে একটি বিষয়ে দারুণ অবাক হয়েছেন, তা যোগ করলেন। আমেরিকার অনেক সংস্থার শীর্ষ পদে এখন ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা রাজ করছেন। ‘কিন্তু এই প্রথম কোনও ইউরোপের সংস্থা সেই ভরসা দেখাল। ফলে অবশ্যই লীনার সাফল্য বাড়তি সম্মান দাবি করে বটে!’, বললেন প্রাক্তন বস্।