রুদ্র অনলাইনে ক্লাস করতে চায় না কিছুতেই। আগের দিন ও প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। স্ক্রিনের অন্য দিকে ওর বন্ধু অনিমেষের মা-ও সেটা দেখেছে। অনলাইন ক্লাস অফ হতেই রুদ্রর মা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ছেলের উপরে। সকলের সামনে সে চুপ করে কেন থাকল? এত বার পড়ানো সত্ত্বেও সে উত্তর দিল না? তার পর থেকে ক্লাস করার সময়ে গুটিয়ে যাচ্ছে রুদ্র।
বৃন্দা বাড়িতে মা-বাবা দু’জনেই অফিসের কাজে ব্যস্ত। ওয়র্ক ফ্রম হোম। তায় আবার ভাইয়েরও অনলাইন ক্লাস চলে। ফলে একদিন মায়ের ল্যাপটপ, তো আর এক দিন বাবার। ভাই-বোনের ল্যাপটপ নিয়ে কাড়াকাড়ি আছেই। বাবা-মায়ের মিটিং চললে, ক্লাসও করা হয় না নিয়মিত। ফলে রেজ়াল্টে এ প্লাস পাওয়া মেয়েটি দিনদিন মুষড়ে পড়ছে ক্লাসে পিছিয়ে পড়ার চিন্তায়।
মাসের পর মাস ঘুরে যাচ্ছে। সন্তানের স্কুল আপাতত স্ক্রিনে। কলেজের ক্লাসও চলছে অনলাইনে। কিন্তু রোজকার স্কুলের পড়াশোনা, আনন্দ কি ওরা ই-স্কুলে পাচ্ছে? বাড়িটাই যখন অফিস, স্কুলে বদলে গিয়েছে, তখন সেখানে অবসাদ, হতাশারাও যে এসে বাসা বাঁধছে। খেয়াল রাখতে হবে সে দিকেও। সব কিছুর ঠিক ব্যালান্স করতে পারলে তবেই অনলাইন ক্লাসের পড়াশোনার নির্যাস পৌঁছবে সন্তানের কাছে।
আলাদা ওয়র্কস্পেস জরুরি
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বললেন, ‘‘বড়দের কাজ করার যেমন ওয়র্কস্পেস থাকছে, সন্তানের জন্যও ঠিক তেমনই একটা পড়াশোনার জায়গা করে দেওয়া খুব জরুরি। যেমন রোজ স্কুলে গেলেই প্রত্যেকে পড়াশোনার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়। এই স্পেসটায় এলেও ওরা পড়ার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে যাবে।’’ বাড়িতে জায়গা কম থাকলেও অন্ততপক্ষে একটা চেয়ার টেবিল দিয়ে সন্তানের পড়ার জায়গা করে দিন। ল্যাপটপে ক্লাস করা গেলে ভাল। এতে ওদের দেখতে, পড়তে সুবিধে হয়। ফোনে ক্লাস করার সময়ে চোখে চাপ পড়ে বেশি।
সময়ের ভাগ করে নিন
অনেক বাড়িতেই হয়তো একটা ল্যাপটপ, কিন্তু তাতে কাজ করছেন তিন জন। সে অফিসের কাজ হোক বা স্কুলের পড়াশোনা। কোনওটাই লঘু ভাবে দেখা যাবে না। প্রত্যেকে সময় ভাগ করে নিন। দরকার হলে সেই মতো অফিসে বা স্কুলেও কথা বলে রাখুন। এতে প্রত্যেকের কাজে সুবিধে হবে। সন্তানের মনে হবে না যে সে বঞ্চিত হচ্ছে। কখনও তার ক্লাস বন্ধ করতে হলে আগে থেকে সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, মিনিস্ট্রি অফ এইচআরডি-র গাইডলাইন অনুসারে, প্রত্যেক দিন ৯০ থেকে ১২০ মিনিট মতো অনলাইন ক্লাস করা যাবে। ২ ঘণ্টার বেশি ক্লাস করা যাবে না। স্কুলের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ছুটির দিনে ছাত্রছাত্রীদের ছুটিও দিতে হবে। সুতরাং সেই কথা ভেবে নতুন শেডিউলের জন্যও তৈরি থাকতে হবে সন্তান ও অভিভাবকদের।
দূর থেকে নজর রাখুন
সন্তানের বয়স যা-ই হোক না কেন, অনলাইন ক্লাস চলাকালীন অনেক অভিভাবকই পাশে বসে থাকেন। এতে সন্তানের মানসিক চাপ তৈরি হয়। পাশে থাকলেও সন্তানকে লেখা বা উত্তর দেওয়ার জন্য জোর দিতে থাকলে চলবে না। বরং টিচারের সঙ্গে ওর ইন্টারঅ্যাকশন যাতে সহজ হয়, সে দিকে খেয়াল রাখুন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘অনেক সময়েই অভিভাবকরা অনলাইনে যে শিক্ষক বা শিক্ষিকা পড়ান, তাঁর পড়ানোর ভুল ধরেন। এতে সন্তানের মনে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সে শিক্ষককে ভরসা করবে না মা-বাবাকে, বুঝতে পারে না।’’ অনলাইন ক্লাসে সন্তানকে কী পড়ানো হচ্ছে, কী ভাবে পড়ানো হচ্ছে, তা মনিটর করা থেকে বিরত থাকতে হবে অভিভাবককে। আগে যেমন স্কুলের উপরে ভরসা রাখতেন, সেটাই করতে হবে। পায়েল ঘোষের কথায়, ‘‘সন্তানেরও কিন্তু প্রাইভেসির দরকার আছে। অনেক অভিভাবকই তাদের চ্যাটবক্স চেক করেন বা অনলাইন পড়াশোনার মাঝের কথোপকথন নিয়ে পরে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সে সব করা উচিত নয়। ওকে ওর বন্ধুর সঙ্গে দুটো কথা ওর মতো করে বলতে দিন। বিশেষত টিনএজারদের ব্যক্তিগত স্পেস প্রয়োজন।’’
ভার্চুয়ালটাই সব নয়
মনে রাখতে হবে সারা দিন স্কুলে শিক্ষকদের সান্নিধ্যে, বন্ধুদের মাঝে হেসেখেলে শেখা আর ভার্চুয়াল জগতে শেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। মুখোমুখি দেখা হওয়া, কথা বলা খুব জরুরি। তাই মনে রাখবেন, এটা কিন্তু স্কুলের বিকল্প নয়। শুধু পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার একটা পথ। এই ধরনের ক্লাস করতে করতে বাচ্চাদেরও একঘেয়ে লাগে। তখন সন্তানের উপরে ক্লাস করার চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়। সে সময়ে ক্লাস টিচারের সঙ্গে কথা বলে ওকে দু’দিন বিশ্রাম দিন। জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘‘দীর্ঘক্ষণ অনলাইন ক্লাস করলে মাথায় চাপ পড়ে। বয়স কম হলে তাদের মস্তিষ্কের গঠনও সম্পূর্ণ হয় না।’’ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, ছ’বছর বয়স না হলে তাদের অনলাইন ক্লাস করা উচিত নয়। কারণ ওই বয়সে শিশুদের ব্রেন ডেভলপমেন্ট চলে। এ ছাড়া চোখেও চাপ পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে রেকর্ডেড ক্লাসের সাহায্য নিয়ে সন্তানকে পড়ানোর দায়িত্ব অভিভাবককেই নিতে হবে। পাশাপাশি বাস্তবের স্পর্শ দরকার। ওর দিকে দুটো বই এগিয়ে দিন। যেটা ও স্পর্শ করতে পারবে, এমন জিনিেসর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলুন। তবলা, গিটার থাকলে সেগুলি তুলে দিন ওর হাতে। ক্লাসের মাঝে টিফিন এগিয়ে দিন। খাবারও কিন্তু মুড ভাল রাখে। দিনের একটা সময় সন্তানের সঙ্গে গল্প করুন, আড্ডা দিন। গল্পের ছলেই ওর অনলাইন ক্লাসের সুবিধে-অসুবিধেগুলো বোঝার চেষ্টা করুন।
বসার ভঙ্গি
বয়স ও ক্লাস অনুযায়ী তার সময়সীমাও ভিন্ন। তাই দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করতে বসার ভঙ্গিও ঠিক রাখতে হবে। বিছানায় বসে, ল্যাপটপের উপরে ঝুঁকে পড়ে ক্লাস করা চলবে না। চেয়ার টেবিলে বসেই ক্লাস করার ব্যবস্থা করতে হবে। মেরুদণ্ড থাকবে সোজা। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার থাকবে চোখের লেভেলে। আর মাঝেমাঝে হাত-পা সোজা করে আড় ভেঙে নেওয়াও জরুরি। ঘাড় গুঁজে দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারে কাজ করলে স্পন্ডিলোসিস হওয়ার ভয় আছে।
জাল থেকে সাবধান
যেহেতু অনলাইন ক্লাসের সঙ্গেই ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি থেকে যাচ্ছে। তাই সাবধানতাও জরুরি। অনেকেই ক্লাসের ফাঁকে বা অনলাইন ক্লাস না হলেও ল্যাপটপে নেট সার্ফ করে। তার মধ্যে কারও পাবজির নেশা তো কাউকে গ্রাস করছে অন্য নেশা। তাই ল্যাপটপ বা কম্পিউটারে সে কী করছে, সে দিকে দূর থেকে নজর রাখুন। সারাদিনে সন্তানের স্ক্রিনটাইমও বেঁধে দিতে পারেন।
আলোচনা দরকার
একটা নতুন সিস্টেমের মধ্য দিয়ে এখন পড়াশোনা চলবে। টিচাররাও যেমন নিজেদের আপডেট করছেন, অভিভাবককেও সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। সমস্যা হলে স্কুলের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করুন।
এখন পড়াশোনা জারি রাখতে অনলাইন ক্লাসের বিকল্প নেই। না হলে পিছিয়ে পড়তে পারে আপনার সন্তান। তবে খেয়াল রাখুন, এগোতে গিয়ে যেন সে পিছিয়ে না পড়ে বাস্তব জগতে। বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই হাত ধরা থাকুক ই-স্কুলের।