ব্রায়ান অ্যাডাম্সের গান শুনতে যাবেন সঙ্গীত পরিচালক বনি চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
ডিসেম্বরের শহরে ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’!
নিজের শহরে বসে, নিজের কানে ‘সো হ্যাপি ইট হার্টস’ শোনার অভিজ্ঞতা তো আগে হয়নি! এ এক প্রকার স্বপ্নপূরণই বটে। রকসঙ্গীতের প্রাণপুরুষদের মধ্যে অন্যতম ব্রায়ান অ্যাডাম্স। আমার সঙ্গীতজীবনে ওঁর প্রভাব অনেকখানি।
সালটা ১৯৯১। পশ্চিমবঙ্গে তখন বাম শাসন। রাগপ্রধান গান, রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীত, অতুল-রামপ্রসাদ, খেয়াল কিংবা আধুনিক গানের স্রোতে একটু একটু নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করল বাংলা সঙ্গীতের নতুন একটি ধারা। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে যার অস্তিত্ব ছিল বহু যুগ আগে থেকেই, সেই রকসঙ্গীত প্রাচ্যে নিজের ভিত পাকাপোক্ত করতে শুরু করল। তবে আমি কোনও দিন রকসঙ্গীত গাইব ভেবে গান শিখিনি। বরং ওই গানের ধারাই আমাকে তার মতো করে তৈরি করে নিয়েছে। তার মধ্যে অনেকের অবদান যেমন আছে, তেমন আছে ব্রায়ানেরও।
মঞ্চে ব্রায়ানকে দেখে দর্শক-শ্রোতার উন্মাদনা। ছবি: সংগৃহীত।
যে হেতু আমি বরাবর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেছি, তাই আলাদা করে গাইতে হবে বলে ইংরেজি গান শেখার তাগিদ অনুভব করিনি। বন্ধুরা যেমন মজা করে গানবাজনা করে, শুরুটা তেমনই ছিল। স্কুলেও নানা রকম অনুষ্ঠান হত। সেখানে গান গাইতাম। ক্রমশ ইংরেজি গানের সূক্ষ্ম মোচড়গুলো আমি রপ্ত করতে শুরু করলাম। কিন্তু এক সময়ে আবার কলকাতায় ফিরে আসতে হল। এ শহরেও অনেক অনুষ্ঠানে ইংরেজি গান শোনানোর জন্য ডাক পেতাম। ব্রায়ানের ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’ গাইতে গাইতে মঞ্চে ওঠার একটা আলাদা উন্মাদনা ছিল। তার পর একে একে ‘কাটস্ লাইক আ নাইফ’, ‘ওয়েকিং আপ দ্য নেবারস্’, ‘সো ফার সো গুড’, ‘বেয়ার বোন্স’, ‘রান টু ইউ’ গাওয়ার অনুরোধও আসত। কিন্তু ‘এভরিথিং আই ডু’ এবং ‘ডু আই হ্যাভ টু সে’— আমার জীবনে এই গান দুটোর আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল। কেন সেটা আর লিখছি না। তবে এটুকু হলফ করে বলতে পারি, আমার ছেলেবেলার সঙ্গে যৌবনের সাঁকোটা শক্ত করে বেঁধে দিয়েছিলেন ব্রায়ান। ভাল লাগা, ভালবাসা, প্রেম, হতাশা, বিচ্ছেদ— যে কোনও পরিস্থিতিতে ওঁর গানই আমার কাছে ‘সব পেয়েছির আসর’ হয়ে উঠেছিল।
এক দিকে গান, লাইভ অনুষ্ঠান, অন্য দিকে দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষার প্রস্তুতি— দুই-ই চলছিল তাল মিলিয়ে। অল্প বয়সে পরিচিতি আর পকেট, দুই-ই ফুলেফেঁপে উঠছিল। কিন্তু একটা সময়ে বুঝতে পারলাম, এ শহরে ইংরেজি গান শুনিয়ে কোনও লাভ নেই। তবে এ কথা প্রথম আমার মাথায় গেঁথে দিয়েছিলেন মণিমামা, মানে গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
শ্রোতাদের উদ্দেশে ব্রায়ান। ছবি: সংগৃহীত।
ওই যে বলেছিলাম না, আমার সঙ্গীতজীবনে ব্রায়ানের প্রভাব অনেকখানি। ব্রায়ানের বয়স যখন ১৬, সেই সময়ে ওঁর মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। কানাডার অন্টারিয়ো ছেড়ে মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে ওঁকে চলে আসতে হয় ভ্যাঙ্কুভারে। ওঁর পড়াশোনায় ইতি পড়ে গিয়েছিল সেখানেই। সঙ্গীতই হয়ে উঠেছিল ব্রায়ানের নেশা এবং পেশা। আমার মা-বাবার সম্পর্কে যদিও বিচ্ছেদ আসেনি। তবে বোর্ডের পরীক্ষায় পাশ করার পর আমারও পড়াশোনা এক রকম লাটে উঠে গিয়েছিল। বাড়ির লোকের কথায় কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম বটে, কিন্তু পাকেচক্রে সেটা আর বেশি দূর এগোয়নি। কাকতালীয় হলেও ব্রায়ানের সঙ্গে বনির মিল রয়েছে এখানে।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৯ সাল, এই সময়টা বাংলা সঙ্গীতজগতে যেন রেনেসাঁসের যুগ। সেই সময়ে কলকাতায় ‘ব্যান্ড কালচার’ শুরু হচ্ছে। স্কুল, কলেজ, পাড়ায় চেনাশোনা বন্ধুদের নিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো ব্যান্ড গজিয়ে উঠছে। তার মধ্যে একটু নামকরা ব্যান্ডের গান শোনা যাচ্ছে রেডিয়োয়। পুজো, বিয়ে, পাড়ার কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও তখন সেই সব গান বাজছে। যে হেতু বাংলা ভাষায় বিশেষ দক্ষতা ছিল না, তাই ইংরেজি গান গাওয়ার ঝোঁক আমার বরাবরই বেশি ছিল। কিন্তু মণিমামার কথা মতো নিজের ভাষায় গান গাওয়ার তাগিদও অনুভব করছিলাম। মাঝেমধ্যে স্বাদবদলের জন্য ব্রায়ানের গানও গেয়ে ফেলতাম। তবে বনি চক্রবর্তীকে মানুষ চিনল ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে’ গানটির সূত্রে।
মঞ্চে মগ্ন ব্রায়ান। ছবি: সংগৃহীত।
যত গান আমি বেঁধেছি তাতে থেকে গিয়েছে প্রবীণদের প্রভাব। তার মধ্যে ব্রায়ান অবশ্যই অন্যতম। সেই মানুষটাই স্বয়ং এখানে আসছেন গান শোনাতে। ব্রায়ান এ দেশে আগেও এসেছেন। কিন্তু আমার ওঁকে চাক্ষুষ করার সুযোগ হয়নি। সেই ব্রায়ানই প্রথম বার কলকাতায়। কিন্তু ওই যে বলেছিলাম, কোথাও যেন ব্রায়ানের সঙ্গে অদ্ভুত একটা যোগ রয়েছে আমার। কাকতালীয় ভাবে এখন আমিও কলকাতায় রয়েছি। তাই এই সুযোগ আর হাতছাড়া করতে পারলাম না। আফটার অল, ডিসেম্বরের শহরে 'সামার অফ সিক্সটি নাইন' বলে কথা!
(লেখক: সঙ্গীতশিল্পী এবং সঙ্গীত পরিচালক)