Kunal Sen

বাবা দেখিয়েছিলেন বেদনার চলমান ছবি, মৃণাল-পুত্র আঁকছেন অচেনা দুঃখকে

তার সব দুঃখের নাম মানুষ জানে না। কিন্তু সেই সব বেদনাবোধকে সে চেনে। কুণাল সেন ক্যানভাসে চৌহদ্দিতে ধরতে চাইলেন তেমন কিছু অনুভূতিকে।

Advertisement

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৩ ১২:৫১
Share:

মৃণাল সেন ও কুণাল সেন। বেদনার অনুভব যেন একডোরে বেঁধেছে পিতা-পুত্রকে। ছবি: সংগৃহীত।

পেশায় প্রযুক্তিবিদ। নেশায় চিত্রকর। বেশ কিছুকাল আমেরিকা প্রবাসী। কুণাল সেনের আর একটা পরিচয়, তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক প্রয়াত মৃণাল সেনের পুত্র। ঘটনাচক্রে, ২০২৩ সাল যাঁর জন্মের শতবর্ষ।

Advertisement

অনুভবকে ক্যানভাসে নামিয়ে আনতে গিয়ে মৃণালের পুত্র কুণাল সাধারণত বিমূর্তিকেই বেছে নেন চিত্রভাষা হিসাবে। কিছু দিন আগে কুণালের হাতে আসে একটি বই। একটি অভিধান। জন কোয়েনিগ নামে এক আমেরিকান কবি ‘দ্য ডিকশনারি অফ অবস্কিওর সরোজ’ নামের বইটির লেখক। মানবজমিনে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা এমন কিছু দুঃখ, বেদনা বা অনুভূতিকে কোয়েনিগ এই অভিধানে নিয়ে এসেছেন, যারা মানুষের অনুভবের চৌহদ্দিতে থাকলেও তাদের কোনও নাম নেই। কোয়েনিগ সেই বেদনা বা অনুভূতিগুলিরই নাম দিয়েছেন।

সেই নতুন নামকরণ হওয়া পুরনো দুঃখগুলিই কুণালের কাছে নেমে এসেছে একেবারে অন্য রূপ নিয়ে। সেই সব দুঃখবোধ, অনুভূতিকেই তুলি-কলম-ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করেছেন তিনি।

Advertisement

কোয়েনিগের লেখা বেদনার অভিধান। ছবি: সংগৃহীত।

তার সব অনুভবকে মানুষ যে চেনে না, এ কথা সর্বজনীন সত্য। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে থাকে বেদনাবোধ। দেশ-কাল-পরিবেশ-পরিজন সব মিলিয়ে তৈরি করে এক এক রকমের বেদনার প্রেক্ষাপট। ছোটবেলায় মার্বেল হারানোর দুঃখ থেকে বড় হয়ে বান্ধবী হারানোর দুঃখ, যৌবনে পৃথিবী বান্ধবহীন বলে মনে হলে রেলব্রিজে একা হেঁটে যাওয়ার দুঃখ, এমনকি, দুঃখবিহীনতার দুঃখের কথাও লিখে গিয়েছেন বাংলার কবি-সাহিত্যিকেরা। হয়তো এক বিকেলের নদীতীরের সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে বা শপিং মলের ফুডকোর্টে একা বসে কফি খাওয়ার মুহূর্তটিতে হঠাৎই মনের ভিতর গুমরে ওঠে বিষাদ। কী নামে ডাকা যায় তাকে? মনের ভিতরে উথালপাথাল চললেও তার নাম জানা যায় না। ‘দুঃখ’, ‘বিষাদ’, ‘মনখারাপ’, ‘বিমর্ষতা’, ‘বেদনাবোধ’ ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের শব্দের বাইরেও কিছু দুঃখ থেকে যায়, যাকে মানুষ চেনে, তার সঙ্গে হয়তো একান্তে মুহূর্তে দেখাও হয়ে যায়। শুধু তার নাম জানা নেই বলেই তাকে চেনা গেলেও জানা যায় না। সেই অপরিচিত দুঃখগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে কলম, থুড়ি কি-বোর্ড ধরেছেন জন কোয়েনিগ। প্রথমে একটি ওয়েবসাইট ও পরে একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিয়োর মাধ্যমে এই অপরিচিত দুঃখ-বেদনের নামগুলির সঙ্গে পরিচয় করাতে শুরু করেন কোয়েনিগ। তার পর অভিধানটির প্রকাশ।

কোয়েনিগ সাহেবের অভিধানে বা নতুন দুঃখের নামকরণের ব্যাপারে ভাষাদর্শনের একটা বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। এই প্রকল্প এমন কিছু অনুভূতির উপর আলোকপাত করতে চায়, যা প্রাত্যহিক জীবনে অহরহ উঁকি দেয়। কিন্তু তাদের নামকরণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। পশ্চিমি অভিধায় এ ধরনের কাজকে ‘নিওলজিজ়ম’ বলা হয়। বাংলায় এর অর্থ ‘সম্পূর্ণ নতুন শব্দ সৃষ্টি’।

কুণাল সেনের আঁকা ‘সন্ডার’ বা অন্যের জীবননাট্যে আপনি একজন অতিরিক্ত অভিনেতা মাত্র, এই অনুভব থেকে জন্মানো বেদনাবোধ। (ক্যানভাসে কালি ও অ্যাক্রেলিক)। ছবি: ফেসবুক।

কুণালের কথায়, এই প্রকল্পের ভিতরে বসত-করা কাব্যিকতাই তাঁকে ছবিগুলি আঁকতে অনুপ্রাণিত করছে। কোয়েনিগের ইউটিউব চ্যানেল তিনি দেখেননি, অভিধানের ভিতরে কিছু ছবি অবশ্য রয়েছে। কিন্তু সে সব ছবিতে মানুষী অবয়ব ব্যবহৃত। কুণালের মনে হয়েছিল, অবয়ব-নির্ভর না হলেই বোধ হয় অনুভূতিগুলির সব থেকে কাছে পৌঁছনো সম্ভব। ক্যানভাসে কালি ও অ্যাক্রেলিকের ব্যবহারে তিনি এঁকেছেন ‘ওচ্চিওলিজম’ বা নিজের অনুভূতির মৌলিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বোধ থেকে জন্মানো দুঃখ। অসীম আকাশের সামনে দাঁড়ালে বা দিগন্তহারা সমুদ্রের বুকে ভাসমান অবস্থায় মানুষের মধ্যে জাগতে পারে এই বিশালত্বকে নিজের অনুভবের গণ্ডিতে নিয়ে আসার অক্ষমতা সংক্রান্ত আক্ষেপ। বা তাকে বর্ণনা করার মতো ইন্দ্রিয় না থাকার বেদনা। সেই অনুভূতিকে শব্দে বেঁধেছেন কোয়েনিগ। আর কুণাল তাকে বাঁধছেন রঙে-রেখায়-ক্যানভাসে। কোয়েনিগের শব্দ নির্মাণের পিছনে কাজ করেছিল ইটালিয়ান ‘ওচ্চিওলিনো’ শব্দটি, যার অর্থ ‘ক্ষুদ্র চোখ’। কুণালের ক্যানভাসে জ্যামিতিক ধূসরিমার মধ্যেই সীমিত বহু রঙের রঙিন এক খোপ সেই ক্ষুদ্রতার কথাই বলে।

কুণাল এই অভিধান থেকে আর একটি শব্দকে বেছে নিয়েছেন— ‘সন্ডার’। যার অর্থ, হঠাৎই এমন অনুভূতির উদয় হওয়া, যেখানে মনে হয়, আশপাশের প্রবহমান মানুষের স্রোতে প্রত্যেক ব্যক্তিই তাঁর নিজের জীবননাট্যের মুখ্য চরিত্র। আর যিনি এ সব ভাবছেন, তিনি সেই নাটকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে থাকা এক অতিরিক্ত অভিনেতা মাত্র। সেই বিপুল নাটকে তাঁর কোনও ভূমিকাই প্রায় নেই। শব্দটির পিছনে রয়েছে জার্মান ‘সন্ডার’ এবং ফরাসি ‘সন্ডার’ শব্দ দু’টি। জার্মান ‘সন্ডার-এর অর্থ ‘বিশেষ’ আর ফরাসি শব্দটির অর্থ ‘নিরীক্ষণ’। কুণাল এই ‘বিচ্ছিন্নতার বোধ’-কে ধরেছেন জটিল বিনুনির মতো বিন্যাসে আবিল প্রেক্ষাপটে সামান্য একটু অংশে রঙের ছোঁয়া দিয়ে। যে রঙ মনখারাপের। তা যেন বিস্তৃত জটিল বিনুনি-বিন্যাসের জীবনস্রোতের সঙ্গে মিশতে গিয়েও মিশতে পারছে না।

কুণাল সেনের তুলিতে ‘ওচ্চিওলিজম’ বা নিজের অনুভূতির মৌলিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে বোধ থেকে জন্মানো দুঃখ। (ক্যানভাসে কালি ও অ্যাক্রেলিক)। ছবি: ফেসবুক।

আমেরিকায় পিএইচডি করতে গিয়েই ছবি আঁকা শিখতে শুরু করেন কুণাল। প্রথমে আঁকার ব্যাপারটা নিয়মিত ছিল না। গত বছর পনেরো ছবি আঁকার বিষয়টি নিয়ে বেশ সিরিয়াস চিন্তাভাবনাই করছেন তিনি। কুণাল এমন একজন মানুষের সন্তান, যিনি চলমান ছবি এঁকেছেন সেলুলয়েডে। ‘ভুবন সোম’ থেকে ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘খারিজ’ থেকে ‘খণ্ডহর’— বেদনার অগণিত বর্ণালিকে দেখা গিয়েছে তাঁর ক্যামেরায়। কেমন হত যদি মৃণাল সেন এই বই হাতে পেতেন? চলচ্চিত্রকারের জন্মশতবর্ষে দাঁড়িয়ে কুণাল বললেন, “বাবাকে বিষয়টা অবশ্যই আকর্ষণ করত। কারণ, বাবা সব কিছুর মধ্যেই ইমেজ খুঁজতেন। ইমেজ দিয়েই ভাবতেন।” উদাহরণ দিতে গিয়ে কুণাল জানালেন, মৃণাল সেন দু’টি শব্দের মূর্তরূপ নিয়ে প্রায়ই বলতেন। একটি ‘কৌতুক’ অন্যটি ‘ভয়ঙ্কর’। ‘কৌতুক’ শব্দটি উচ্চারিত হলেই তাঁর মনে হত, কেউ যেন দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর তাকে কাতুকুতু দেওয়া হচ্ছে। ‘ভয়ঙ্কর’ শব্দটি তাঁর কাছে ছিল সে কালের পন্টুন-ওয়ালা হাওড়া ব্রিজের মতো। শব্দটি দেখলেই তাঁর মনে হত, ‘ভয়’ আর ‘কর’-এর মাঝখানে অনুস্বরটি মাত্রাহীন অবস্থায় যেন একটি পন্টুন খোলা ব্রিজকে চোখের সামনে তুলে ধরছে। এই বই হাতে পেলে হয়তো এ থেকেই কোনও ছবির রসদ পেয়ে যেতেন ‘মৃগয়া’র পরিচালক।

কোয়েনিগের শব্দসন্ধান হয়তো এক বিশ্বজনীনতার কথা মাথায় রেখে। কিন্তু কুণাল জানালেন, এই অভিধানের সমস্ত শব্দ কিন্তু সব দেশের, সব সংস্কৃতির মানুষের কাছে কোনও ব্যঞ্জনা না-ও রাখতে পারে। কারণ, বেদনাবোধ অনেক সময়েই দেশ-কাল-পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। তিনি তাঁর ছবির জন্য সেই শব্দগুলিই বেছে নিচ্ছেন, যেগুলি এক বঙ্গসন্তান হিসেবে তাঁর কাছে বা তাঁর হৃদয়ের কাছে এসে ঢেউ ভাঙছে।

কোয়েনিগের ইউটিউব ভিডিয়োর সঙ্গে কুণালের ছবির কোনও সম্পর্ক নেই। দেড় থেকে তিন মিনিটের সেই সব ভিডিয়োয় খণ্ড খণ্ড মুহূর্তে কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। সেই সব দৃশ্যের অভিঘাত অন্য রকমের। কুণালের মাধ্যম ফ্রেমের চৌহদ্দিতে আটকে থাকা ক্যানভাস। এখানে বেদনা স্থির। অজস্র জ্যামিতিক নকশায় ভরাট এক পরিসরে সে নতুন রং নিয়ে আসে। চারপাশের ছড়িয়ে থাকা চেনা দুঃখ, চেনা সুখ, চেনা চেনা চায়ের গেলাসের এই জীবনে সে একটু অপরিচয়ের অভিজ্ঞান নিয়ে এলেও অনুভবী মানুষ তাকে ঠিকই চিনতে পারবেন। বিশ্বপ্রকৃতির সব ঐশ্বর্য নিজের মস্তিষ্কে ধারণ করতে না পারার বেদনা থেকে কোনও ভাবনাই আর মৌলিক নয়— এই বোধে পৌঁছে যে বেদনার জন্ম হয়, তাকেই মৃণাল-তনয় ফুটিয়ে তুলছেন তাঁর ক্যানভাসে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement