Book Shops in Kolkata

কলেজ স্ট্রিট পাড়ার বাইরে কেমন আছে কলকাতার পুরোনো বইদোকানগুলি?

কলেজ স্ট্রিট বাঙালির বইয়ের দেশ। বই কিনতে সেখানেই ছোটেন সকলে। তবে এই পাড়ার বাইরেও আছে বই কেনার ঠিকানা। সেগুলি কি বিস্মৃত?

Advertisement

দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:২২
Share:

কলেজ স্ট্রিটের বাইরের বইয়ের ঠিকানা। —নিজস্ব চিত্র।

বইপাড়া বলতেই আমরা বুঝি কলেজ স্ট্রিট। বই বেচাকেনার ‘বড়বাজার’ তো সেটিই। কিন্তু, কলেজ স্ট্রিটের বাইরেও গোটা কলকাতায় কয়েক দশক জুড়েই ছড়িয়ে আছে অজস্র পুরোনো বইদোকান। তা সে গড়িয়াহাট, রাসবিহারীই হোক বা ভবানীপুর, উল্টোডাঙা। ফরাসি মুলুকেও যেমন রাস্তায় বই পাওয়া যায়, এ শহরেও তেমনই গোলপার্ক বা রাসবেহারীর রাস্তার ফুটপাথজুড়ে পড়ে থাকে সারি সারি বইপত্র। সে বই এসে নেড়েচেড়ে দেখেছেন কখনও সমর সেন, তো কখনও সত্যজিৎ...

Advertisement

স্বাধীনতার আগে বা তার পরবর্তী সময় থেকে নিরলস বই বিতরণ করে চলেছে এই সব দোকান। লাভের কথা না ভেবেই এক রকম সেবাই যেন বা করে চলেছেন তাঁরা। অনেক দোকান একান্তই না চলতে পেরে আজ উঠেও গেছে। যেমন নন্দনের সামনে সিনেমা ও

যে শহর সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, সেখানে কেন বইপত্রের ঠেকগুলির এই আকাল?

নানা দুর্লভ বিষয়ের বই বিক্রি করতেন হাওড়া-নিবাসী এক বিক্রেতা। সাইকেল চালিয়ে বইগুলি নিয়ে আসতেন তিনি। আর তাঁকে দেখা যায় না বহু দিন। তেমনই হাজরা মোড়ের কাছে নানা পত্রপত্রিকা নিয়ে বসতেন একজন। বর্তমানে তিনি চিরুনি-আয়না জাতীয় জিনিস বিক্রি করেন। উঠে যাওয়া বইদোকানের তালিকায় রয়েছে দেশপ্রিয় পার্কের কাছের দক্ষিণী, গোলপার্ক-গড়িয়াহাটের অজস্র বিপণি। অনেক দিন আগেই উঠে গিয়েছে লোকাল রেলস্টেশন চত্বরের একাধিক দোকানও। অন্যান্য যে বইয়ের দোকান আজও চলেছে, সে সব জায়গায় বিক্রি প্রায় হয় না বললেই চলে। তবু নেহাত ভালোবাসা ও বই-সেবা করার ব্রতের জায়গা থেকে দোকানগুলি রেখে দিয়েছেন কর্ণধারেরা। নিত্য প্রোমোটারের চাপ, কর্মীদের বেতনের চাপ এবং সর্বোপরি অনলাইন প্রযুক্তির চাপ সামলেও লড়ে যাচ্ছেন সকলে। যে শহর সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, সেখানে কেন বইপত্রের ঠেকগুলির এই আকাল? এ শহরেই তো নির্মাল কুমারের মতো মানুষ থাকতেন, যাঁর বাড়ির বই

Advertisement

—নিজস্ব চিত্র।

সংগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়, যাঁর আদলে নাকি সত্যজিৎ বানিয়েছিলেন সিধুজ্যাঠাকে। বিক্রেতাদের কণ্ঠে মূলত যে সুর শোনা গেল, তা এককথায় বললে, আগের প্রজন্মের বইপোকাদের অর্থাৎ নিরন্তর বইখোঁজা মানুষদের সংখ্যা কমছে। পরের প্রজন্ম হয়তো এই ভালোবাসার গুপ্তধনের হদিস জানতে চাইছেন না, তাঁদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে অন্য কিছু। কাজেই কলেজ স্ট্রিটের বাইরে এই সব দোকান টিকিয়ে রাখার যে নাছোড় লড়াই, তা থেকে বহু ক্রোশ দূরে চলে যাচ্ছে বই ব্যবসায়ীদের পরের প্রজন্মও। কথা হচ্ছিল ভবানীপুরের বহু পুরোনো বইদোকান ‘ভবানীপুর বুক ব্যুরো’র কর্ণধার দেবীপ্রসাদ ঘোষের সঙ্গে৷ স্বাধীনতার আগে থেকেই এই দোকান চালিয়ে আসছে তাঁর পরিবার৷ দোকানটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৩২। কলকাতার পড়ুয়া মানুষদের মণিকোঠায় আজও জ্বলজ্বল করছে এই দোকান। দশকের পর দশক ধরে মানুষকে লাভের কথা না ভেবেই বই বিক্রি করছেন তাঁরা। দেবীপ্রসাদবাবু জানালেন, তাঁর ছোটদাদু নিমাইদাস রায়চৌধুরী এ দোকান পত্তন করেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল টাকিতে। পার্ক স্ট্রিটেও ‘পার্ক বুক ব্যুরো’ নামে তাঁদের একটি দোকান ছিল। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজেত উন্মুক্ত আকাশতলায় ছিল দোকানটি। ফুটপাথ থেকেই সে দোকান শুরু করেন নিমাইবাবু। সাহায্য করেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তার পর তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবা প্রবোধকুমার ঘোষ ও গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের স্কলারশিপ পাওয়া কাকা সুবোধকুমার ঘোষ এ দোকানের দায়িত্ব নেন। সেই থেকেই চলছে দোকানটি। নিয়মিত প্রেমেন্দ্র মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরা আসতেন এই দোকানে। দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের সঙ্গেও তাঁর অল্পবয়সের ছবি দেখালেন তিনি৷ বর্তমানে দেবীপ্রসাদবাবু ও তাঁর পরিবারের সকলে মিলেই চালাচ্ছেন এই দোকান। শুধু গল্প-উপন্যাসই না, স্কুলপাঠ্য বইয়ের কারণেও বহু কাল ধরেই প্রসিদ্ধ দোকানটি। তবে তিনি স্পষ্টই জানান, বর্তমানে দোকানটির লাভ প্রায় নেই। এর কারণ, পাঠক কমেছে, পাঠকের রুচি বদলেছে। অবসরভাতা ও পরিবারের সহায়তা থেকেই দোকানটি চালাচ্ছেন তাঁরা। পূর্ণ সিনেমা হলের কাছে যে পুরোনো বাড়িতে এই দোকান, সে বাড়িটিকেও প্রোমোটার চাইছেন নবীকরণ করতে। যদিও সরাসরি দোকান তুলে দেওয়ার কথা তাঁরা বলেননি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে দোকানটি কতদিন চালাতে পারবেন, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় দেবীপ্রসাদবাবু।

—নিজস্ব চিত্র।

প্রায় একই সুর শোনা গেল গড়িয়াহাট বাজারের ‘অহনয়ন’ বইদোকানের কর্ণধার প্রবীর চট্টোপাধ্যায়র গলায়। প্রায় ৪২ বছর ধরে এ দোকানটি তিনি চালিয়ে আসছেন৷ মূলত দুষ্প্রাপ্য বইয়ের কারণেই খ্যাত ‘অহনয়ন’। ফ্লাইওভার হওয়ার আগে গড়িয়াহাট মোড়ের বুলেভার্ডে ছিল এই দোকান। তখন থেকেই বইপড়ুয়ারা ভিড় জমাতেন এখানে। চল্লিশ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সেই সব পাঠকেরা আজ আবিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছেন। তাঁরাই আজও মূল ভরসা ‘অহনয়ন’-এর। প্রবীরবাবু আজও কোনও বিশেষ বিষয়ে কোনও পাঠকআগ্রহী হলে, তাঁকে সহায়ক আরও কিছু বই নিজের গরজে খুঁজে এনে দেন। ছাত্রছাত্রীদের জন্য সব সময় খোলা প্রবীরবাবুর সংগ্রহের দরজা। এ দোকানেনিয়মিত আসতেন প্রখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষ-সহ বহু বিশিষ্টজন। প্রবন্ধিক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের বাড়িতে বই পৌঁছে দিতেন প্রবীরবাবু। আসতেন মহাশ্বেতা দেবী, নবারুণ ভট্টাচার্যেরাও। প্রবীরবাবুর মতে, এ কারণেই এই আকালেও ‘অহনয়ন’ কোনও রকমে এগিয়ে চলেছে পাঠকদের ভালোবাসায়, যে পাঠকেরা নিয়মিত ভিড়ও জমান এই দোকানে সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটা দিনে। বলা চলে, দক্ষিণ কলকাতার ‘সুবর্ণরেখা’ হয়ে উঠেছে ‘অহনয়ন’।

রাসবেহারী মোড়ের কল্যাণবাবুর বইদোকান গত বেশ কয়েক দশক ধরেই লিটল ম্যাগাজিনের জন্যে খ্যাত ছিল। কিন্তু হালফিল আর তেমন বিক্রি নেই এই সব পত্রপত্রিকারও। তা ছাড়া, পত্রিকাগুলির মানও পড়েছে বলে মনে করেন কল্যাণবাবু। কাজেই বিক্রির জন্য

তবে কি নতুন প্রজন্ম বই পড়বে না? অনলাইন আর ওয়েব সবটা দখল করবে? কী মনে করছেন বিক্রেতারা? —নিজস্ব চিত্র।

ইংরেজি ও ফ্যাশন ম্যাগাজিনও রাখতে হয় তাঁকে। তিনি জানালেন, কলেজ স্ট্রিটেই পাঠক বেশি ছাড় পান। তাই এই সব দোকানে তেমন একটা আসেন না তাঁরা। তা ছাড়া, অনূর্ধ্ব চল্লিশের পাঠকেরাও আর বাংলা বই বিষয়ে তেমন উৎসুক নন। এ শহরে বহু দিন ধরেই বাইকে চেপে পাঠককে বই পৌঁছে দিচ্ছেন তরুণ সাউ। তিনিও তাঁর বাবার সুবাদেই এই ব্যবসায় আসেন। কলকাতার সংবাদমাধ্যমের দফতর তথা প্রখ্যাতদের বাড়িতেও নিয়মিত বই পৌঁছে দিয়েছেন তরুণবাবু৷ বিখ্যাতদের তালিকায় আছেন ঋতুপর্ণ ঘোষও। জানালেন, কলকাতার নানা প্রান্তে ছুটে বই দেওয়ার যে আনন্দ তার স্বাদই আলাদা। অবশ্যই উপার্জন জরুরি ছিল। কিন্তু এ আনন্দ ছেড়ে কখনওই অন্য পেশায় যাওয়ার কথা ভাবেননি তিনি। তবে তার পরের প্রজন্ম কি আসতে চাইবেন এই পেশায়? তরুণবাবু স্পষ্টই জানালেন, “না।”

তবে কি নতুন প্রজন্ম বই পড়বে না? অনলাইন আর ওয়েব সবটা দখল করবে? কলেজ স্ট্রিটের বাইরে এই সব দোকান কি চিরতরে মুছে যাবে? এ কথা অনেকাংশে সত্যি হলেও মেনে নিতে চান না এই বই-বিক্রেতারা। সিনেমার বা অন্য শিল্পমাধ্যমের প্রয়োজন ফুরোলেও, বই থেকে যাবে বলেই তাঁদের বিশ্বাস। কেন না, সভ্যতার আদি থেকে বই মানুষের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু। তাই এত প্রতিকূলতার

পরেও দোকানগুলিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখেন এই সব সাধারণ দোকানীরা। এখনও তাঁদের আশা, ঠিক কোনও না কোনও নতুন পাঠক আসবেন আবার, এসে হাতে তুলে নেবেন নতুন কোনও বই! ফেলুদাকে দিয়ে সত্যজিৎ যেমন বলিয়েছিলেন, নিউ মার্কেট ভেঙে গেলে

অনশনে বসবেন, এই সব পুরোনো দোকান মুছে গেলেও যে অনেক কলকাতাবাসী মুখ বুজে

মেনে নেবেন না, তা ভালই জানেন তাঁরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement