Asadharan

গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে শতাধিক ডুবন্তকে বাঁচিয়েছেন, তুলে এনেছেন হাজারখানেক মৃতদেহ

সব প্রতিকূলতাকে জয় করে আমৃত্যু জলকেই ভালবাসতে চান বীরেন। ‘কোনি’ হওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁর ‘ক্ষিদ্দা’র চেনানো জলই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। অন্যকেও বাঁচায়।

তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে বীরেন। গঙ্গায় এক মহিলাকে ভেসে যেতে দেখে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। —নিজস্ব চিত্র।

পায়েল ঘোষ

হাওড়া শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২১ ১৯:৩১
Share:

তাঁর জীবনেও এক জন ‘ক্ষিদ্দা’ ছিলেন। তাঁর মা। তবে বীরেন কর্মকারের আর ‘কোনি’ হয়ে ওঠা হয়নি। কিন্তু জলের প্রতি প্রেমটাও সরিয়ে রাখতে পারেননি। জলই তাঁর বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠেছে। অন্যকে বাঁচানোর নেশাও।

ছোটবেলায় রোজ মায়ের সঙ্গে গঙ্গাস্নানে যাওয়া। তখন বীরেনের বয়স পাঁচ বা ছয়। মা সুভদ্রা প্রতি দিন নিয়ম করে গঙ্গাপাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে জলে ভাসিয়ে সাঁতার শিখিয়েছিলেন ছেলেকে। প্রথম প্রথম ভয় করত। কিন্তু বেশ কয়েক দিন পর থেকে জলকে ভালবেসে ফেলেছিল বীরেন। জল থেকে উঠতেই চাইত না। এখন বীরেনের বয়স ৫২। তাঁর এই দীর্ঘ জল-জীবনে প্রায় শতাধিক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন বীরেন। ডুবে যেতে যেতে প্রায় মৃত্যুর মুখে চলে যাওয়া সেই সব মানুষদের বাঁচিয়ে তিনি হয়তো একটা তৃপ্তি অনুভব করেন। কিন্তু দুঃখের পরত অন্যত্র লেগে আছে। প্রায় হাজারখানেক মানুষের দেহও উদ্ধার করেছেন বীরেন। জলে ডুবে তাঁরা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী যখন ব্যর্থ, তখন বীরেনই ভরসা। জলে নেমে তিনিই ত্রাতা। পরিবারের কাছে অন্তত দেহগুলো তো পৌঁছে দিতে পেরেছেন। এটুকুইু সান্ত্বনা।

তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে বীরেন। গঙ্গায় এক মহিলাকে ভেসে যেতে দেখে নিজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তার পর সাঁতার কেটে তাঁর কাছে পৌঁছনো। কোনও রকমে টেনেহেঁচড়ে জল ভেঙে পাড়ে নিয়ে আসা। প্রাণ ফিরে পাওয়া যেন। বাচ্চা ছেলেটিকে অনেক আশীর্বাদ করেছিলেন মহিলা। সে দিনের স্মৃতি এখনও স্পষ্ট বেলুড়ের লালাবাবু শায়র রোডের বাসিন্দা বীরেনের কাছে। তার পর এখনও পর্যন্ত গুনেগেঁথে ১০৪ জন। এত মানুষকে গঙ্গার জলে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচানো!

সম্মান-স্বীকৃতি —নিজস্ব চিত্র।

বীরেন বলছিলেন, ‘‘তখন বারো ক্লাসে পড়ি। সে দিন দোলপূর্ণিমা ছিল। বেলুড়ের ঘাটেই স্নান করছিলাম। হঠাৎ সকলে চিৎকার করতেই বুঝতে পারলাম দুটো ছেলে ভেসে যাচ্ছে। কোনও রকম তাদের এক জনকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাই। জিতেন্দ্র সিংহ। সে বারই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল। অনেক কষ্টে ছেলেটাকে পাড়ে আনি। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর জিতেন্দ্রই বলেছিল, ওর এক বন্ধু ছিল। সে ভেসে গিয়েছে। আবার জলে নেমে খোঁজ। সে দিন সন্ধ্যায় সঞ্জয় মিশ্র নামে ওই কিশোরের দেহ আমিই তুলেছিলাম গঙ্গা থেকে। খুব কেঁদেছিলাম সে দিন।’’

সাঁতারকে ভালবেসেও বীরেনের মন বুঁদ হয়েছিল ফুটবলে। বেলুড় বয়েজ স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও বেলুড় লালবাবা কলেজ থেকে স্নাতক। দাশনগর সিটিআই কলেজ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর বেলুড় শিল্পমন্দির কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমাও করেন। বাবা গাঁধী কর্মকার বেলুড়েরই একটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কিন্তু ফুটবল খেলবেন বলে একাধিক চাকরি ফিরিয়ে দেন বীরেন। বেলুড় প্রতিভার হয়ে প্রথম ডিভিশন খেলেছেন বহু দিন। বেলুড়ে যুব সমিতির মাঠে চলত অনুশীলন। সেই মাঠেই বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় ও সমর কুমারের মতো ফুটবলারের সঙ্গে খেলেছেন। ফুটবল খেলে যা টাকা পেতেন তাতেই চলে যেত। এর পর এক দিন এল সেই সুযোগ। ইস্টবেঙ্গলে সই করবেন। ঠিক তার আগেই পায়ে চোট লাগল। স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। বীরেন এখন একটা জুটমিলের নিরাপত্তা আধিকারিক!

সে বারের দশমীর দিনটার কথা সারা জীবন মনে থাকবে বীরেনের। ২০১৪ সাল। শিলং থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেলুড়ে ঘুরতে এসেছিল অভিষেক অর্জুন নামের এক কিশোর। উঠেছিল বেলুড় মঠের অতিথিশালায়। দশমীর সকালে স্নান করতে নেমেছিল গঙ্গায়। সাঁতার জানত না। ফলে জলের তোড়ে ভেসে যায়। ঘটনাচক্রে তখন গঙ্গায় স্নান করছিলেন বীরেনও। কোনও রকমে উদ্ধার করেন অভিষেককে। ‘‘ছেলেটা অনেক জল খেয়ে ফেলেছিল। সাঁতার জানত না তো! বেশ কিছু ক্ষণ পর সুস্থ হয়। ওকে তখন বলেছিলাম, তোকে সাঁতার শেখাব। কাল এই সময়ে আসিস’’— স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বললেন বীরেন।

সাঁতার তিনি এখনও শেখান। কেউ ২০ সেকেন্ড জলে মাথা ডুবিয়ে থাকতে পারলেই বীরেনের কাজ জলের মতো সোজা হয়ে যায়। বলছিলেন, ‘‘কেউ ২০ সেকেন্ড জলের মধ্যে মাথা ডুবিয়ে রাখতে পারলে আমি তাকে ১৫ মিনিটে সাঁতার শিখিয়ে দেব। চ্যালেঞ্জ! খুব সহজ ব্যাপার। বৌ-ছেলে-মেয়ে-বাচ্চা-বুড়ো হেন কোনও বয়স নেই যে আমি সাঁতার শেখাইনি।’’ লকডাউনের মধ্যেও প্রচুর মানুষকে বিভিন্ন ঘাটে গিয়ে সাঁতার শিখিয়েছেন। তবে শিক্ষক বীরেন তার জন্য কোনও পয়সা নেন না। বিভিন্ন থানা, ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পাশাপাশি বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীও বীরেনকে ডাকে। তাঁর কথায়, ‘‘ওরা নিজেরা ব্যর্থ হলেই ডাক পড়ে। তবে ডাক এলে বুঝি, আমার বেদনা আরও বাড়বে। জ্যান্ত উদ্ধার করতে তো আর ডাকে না।’’

সাঁতার তিনি এখনও শেখান। কেউ ২০ সেকেন্ড জলে মাথা ডুবিয়ে থাকতে পারলেই বীরেনের কাজ জলের মতো সোজা হয়ে যায়। —নিজস্ব চিত্র।

তবে এ সবের জন্য এখনও প্রতি দিন নিজেকে তৈরি করেন বীরেন। অনেক ভোরে ওঠেন। যোগাভ্যাস, শারীরিক কসরত, সাঁতার কাটা— এ সব তাঁর রোজের রুটিন। জলে নামার সময় কোনও অত্যাধুনিক জিনিস ব্যবহার করেন না। চোখে গগলস, মাথায় সিলিকন ক্যাপ, সারা গায়ে অলিভ অয়েল মেখে অল্প একটু মধু খেয়ে জলে ঝাঁপ। জলের তলায় এক এক দফায় ছ’মিনিট করে থাকতে পারেন। এখনও। যে দিন গঙ্গায় যেতে পারেন না, সে দিন বাড়ির রিজার্ভারে নেমে পড়েন। চলে অনুশীলন। জল থেকে সংক্রমণ এড়াতে গায়ে অলিভ অয়েল মাখেন। আর মধু? জলের তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে যদি ঠান্ডা লেগে যায়!

ফুটবলের নেশায় বিয়ে করেননি। বলছিলেন, ‘‘ফুটবল আর মানুষের জীবন বাঁচানোর নেশায় এতটাই মশগুল, যে বিয়ে করার প্রয়োজন মনে করিনি।’’ তাঁর ‘ক্ষিদ্দা’ চলে গিয়েছেন বছর কয়েক আগে। বাবা তারও আগে। তাঁরা তিন ভাইবোন হলেও বীরেন এখন একাই থাকেন। একাই থাকতে চান। এটুকু বলেই কথা ঘুরিয়ে বীরেন বললেন, ‘‘গঙ্গায় তলিয়ে যাওয়া কাউকে বাঁচানো খুব কঠিন। প্রচুর আন্ডার কারেন্ট থাকে।’’

জলে ভেসেও থাকতে পারেন বীরেন। —নিজস্ব চিত্র।

সব প্রতিকূলতাকে জয় করে আমৃত্যু জলকেই ভালবাসতে চান বীরেন। ‘কোনি’ হওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁর ‘ক্ষিদ্দা’র চেনানো জলই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। অন্যকেও বাঁচায়।

Follow us on:
আরও পড়ুন