মাঠের সঙ্গে প্রেম আর চরিত্রের প্রত্যয়ে সে বাধা জয় করতে বেশি সময় নেননি ভারতী। সেই প্রত্যয়ই তাঁর পায়ে পায়ে তৈরি মেয়েদের টিমটাকে কলকাতার মহিলা ফুটবল লিগ পর্যন্ত তুলে এনেছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ছোট ছোট পাস। গোল লক্ষ্য করে লম্বা শট। শটটা গোলে ঢুকতেই সাইডলাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে শাড়ি পরা এক মহিলার উল্লাসে চোখ আটকে যায় পথচলতি মানুষের। ফুটবল মাঠে মহিলা কোচ নতুন কোনও ছবি নয়। তা বলে শাড়ি পরে মাঠে! হ্যাঁ, তিনি শাড়িও পরেন। পায়ে পায়ে ফুটবলও নাচান। শাড়ি পরেই ফুটবল খেলা শেখান ভারতী মুদি। বাঁকুড়ার ছাতনা ব্লকের প্রত্যন্ত দুমদুমি গাঁয়ের বধূ ভারতীর শাড়ি পরে ফুটবল প্রশিক্ষণ এখন রোজকার দৃশ্য! প্রথমে কিন্তু গ্রামের লোকজনের ভ্রু কুঁচকেছিল। কিন্তু মাঠের সঙ্গে প্রেম আর চরিত্রের প্রত্যয়ে সে বাধা জয় করতে বেশি সময় নেননি ভারতী। সেই প্রত্যয়ই তাঁর পায়ে পায়ে তৈরি মেয়েদের টিমটাকে কলকাতার মহিলা ফুটবল লিগ পর্যন্ত তুলে এনেছে। শুধু তা-ই নয়, ভারতীর প্রশিক্ষণে বড় হওয়া অনেকেই খেলে ফেলেছেন বাংলা দলেও।
সাধারণ এক আদিবাসী পরিবারের বধূ ভারতী। বৈবাহিক সূত্রে এসেছিলেন বাঁকুড়ার গ্রামে। ছোটবেলা কেটেছে বর্ধমানের এক আদিবাসী গ্রামে। স্কুলজীবনে ভারতীর ভাল লাগত অ্যাথলেটিক্স। দক্ষতা ছিল। কিন্তু প্রথাগত প্রশিক্ষণ ছিল না। তা সত্ত্বেও স্কুল স্তর পেরিয়ে ব্লক, তার পর জেলা স্তর ডিঙিয়ে রাজ্য স্তরের আটশো মিটার দৌড়ে তৃতীয় হয়েছিলেন। এ সবের মধ্যেই মনের ভিতর লালন করছিলেন ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছে। প্রত্যন্ত জামগ্রামের মাঠে সমবয়সি ছেলেদের সঙ্গে ‘ফুটবল’ খেলতে নেমে পড়তেন। বল তৈরি হত পলিথিন ব্যাগ দড়ি দিয়ে গোল করে বেঁধে। তার পর কী ভাবে যেন জুটেও গিয়েছিল একটা চামড়ার বল। ভালই খেলছিলেন, তবে খুব বেশি দিন সে খেলা চলেনি। কারণ, আদিবাসী সমাজের রীতি মেনে কম বয়সে বিয়ে হয়ে চলে আসতে হল ছাতনায়।
অ্যাথলেটিক্স থেকে ফুটবল— সমস্ত স্বপ্ন মিলিয়ে গেল। সংসার, সন্তান, সব মিলিয়ে এ সব ভাবারও সময়ও ছিল না। কিন্তু মেজো মেয়ে তানিয়া এক দিন মায়ের কাছে বায়না ধরল। ফুটবল খেলা শেখাতে হবে। সেটা ২০০৯। স্ত্রীকে উৎসাহ দিয়েছিলেন শক্তিপদ মুদি। পেশায় স্বাস্থ্য দফতরের কর্মী। তাঁরও নেশা ফুটবল। জেলা ক্রীড়া সংস্থার নামী রেফারি ছিলেন এক কালে। মূলত শক্তিপদের উৎসাহেই ফের মাঠে নেমে পড়লেন স্ত্রী। ভারতীর কথায়, ‘‘তানিয়াই উদ্যোগী হয়ে ওর বেশ কয়েক জন সহপাঠীকে জোগাড় করল। দুমদুমির মাঠেই শুরু হল বিনা খরচে ফুটবলের প্রশিক্ষণ। প্রথমে হাফ প্যান্ট পরে মেয়েরা মাঠে ফুটবল খেলবে, এটা মানতে চায়নি আদিবাসী পরিবারগুলি। অনেকে অনেক কটূক্তিও করেছে। কিন্তু আমি হার মানিনি।’’
মাঠে নেমে বুঝলেন, ছোটবেলায় খেলা ফুটবলটা ভুলে যাননি। পা এখনও ‘কথা বলছে’ বলের সঙ্গে। প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হল। প্রথম প্রথম মেয়েরা ট্র্যাকস্যুট পরে মাঠে আসত। ভারতী বলছিলেন, ‘‘প্রথম বার কলকাতা লিগে খেলতে গিয়েও মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে মাঠে নামতে রাজি হয়নি। তা নিয়ে ওখানকার ক্রীড়া সংগঠকেরা আমাকে কম কথা শোনাননি। কিন্তু আজ সব কথার জবাব আমি দিতে পেরেছি।’’
মধ্য চল্লিশেও ছিপছিপে চেহারা নিয়ে বলের পিছনে দৌড়ে মেয়েদের শেখান— ট্যাকল বা ডজ-এর কৌশল। ফ্রি কিক থেকে কর্নার কিক। নিজস্ব চিত্র।
শক্তিপদ তাঁর স্ত্রীর এই উত্থানে অত্যন্ত খুশি। বলছেন, ‘‘আমি নিজে বাঁকুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার রেফারি ছিলাম। ফুটবলের প্রতি আমার একটা ভালবাসা ছিলই। স্ত্রী যখন মেয়েদের ফুটবল খেলানোর প্রস্তাব দেয়, আমি তা সানন্দে গ্রহণ করি। আমিও ফাঁকা পেলে ওকে মাঠের প্রশিক্ষণে সাধ্যমতো সাহায্য করি। আমি চাই, লেখাপড়ার পাশাপাশি আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া সমাজের মেয়েরা এগিয়ে যাক খেলাধুলোতেও।’’
বৃহত্তর কলকাতার বাইরের একমাত্র মহিলা দল হিসাবে ভারতীর হাতে গড়া ‘দুমদুমি আদিবাসী তরুণী ব্রজেন সংঘ’ কলকাতায় আইএফএ-র মহিলা ফুটবল লিগে অংশ নেয়। ২০১৯ সালে লিগের সুপার সিক্সে ওঠে। কিন্তু তার পর চলে এল কোভিড। এল লকডাউন। ২০১৯ সালের পুরুলিয়া জেলা পুলিশ আয়োজিত সৈকত কাপে রীতিমতো মাঠ কাঁপিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারতীর দল। চ্যাম্পিয়ন দল হওয়ার সুবাদে ওই দলের এগারো জন মহিলা ফুটবলার সিভিককর্মী হিসাবে কাজও পান। তবে সেখানেই থেমে থাকেনি ভারতীর স্বপ্নের উড়ান।
২০১৯ সালের পুরুলিয়া জেলা পুলিশ আয়োজিত সৈকত কাপে রীতিমতো মাঠ কাঁপিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারতীর দল। নিজস্ব চিত্র।
ভারতীর কঠোর পরিশ্রম ও নিখুঁত প্রশিক্ষণের ফসল তাঁর নিজের দুই মেয়ে। তাঁর দলের পাঁচ জন এখনও পর্যন্ত বাংলার হয়ে জাতীয় স্তরের ফুটবল খেলেছেন। ২০০৯ সালে খেলেছেন কেয়া মুদি। সম্পর্কে তিনি ভারতীর বড় মেয়ে। খেলতে খেলতেই নার্সিংয়ের চাকরি পেয়ে যান। ফলে এখন আর খেলার সুযোগ পান না। ওই বছরেই জাতীয় স্তরে খেলেছেন কৃষ্ণা মুদি ও দুলালি বাউড়ি। ২০১১ সালে খেলেছেন সতীমা মুর্মু। ২০১৪ সালে ভারতীর মেজো মেয়ে তানিয়া বাংলার দলে সুযোগ পান। এখনও তিনি নিয়মিত খেলেন।
পিছিয়ে পড়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ভারতীর এই লড়াই নিয়ে গর্বিত প্রাক্তন ফুটবলাররাও। ১৯৯৭-৯৮ সালে সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন বাংলা দলের ফুটবলার ছিলেন গৌরব সেনগুপ্ত। তিনিও বাঁকুড়ার ছেলে। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতী প্রত্যন্ত এলাকায় থেকে যে ভাবে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছেন, সেই উদ্যোগের কাছে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। যে দল থেকে পাঁচ জন মহিলা খেলোয়াড় ইতিমধ্যে জাতীয় স্তরের ফুটবল খেলেছে, সেই দলের প্রশিক্ষকের দক্ষতাও প্রশ্নাতীত। এই ধরনের নিঃস্বার্থ মানুষেরা আছেন বলেই আজও অসংখ্য খেলোয়াড় গ্রামগঞ্জ থেকে উঠে আসছে।’’
একের পর এক সাফল্য এলেও নিজের দলকে নিয়ে আরও এগিয়ে যেতে চান ভারতী। আর সেই লক্ষ্যেই আটপৌরে শাড়ি পরা ভারতী আজও সকালের আলো ভাল করে ফুটে ওঠার আগেই নিয়মিত হাজির হন দুমদুমির কাঁকুরে মাঠে। মধ্য চল্লিশেও ছিপছিপে চেহারা নিয়ে বলের পিছনে দৌড়ে মেয়েদের শেখান— ট্যাকল বা ডজ-এর কৌশল। ফ্রি কিক থেকে কর্নার কিক। স্থানীয় কাঠগড়া গ্রাম থেকে ফুটবলের প্রশিক্ষণ নিতে আসা রিম্পা সিং সর্দার বলছিলেন, ‘‘কোচ আমাদের ফুটবলের শিক্ষা দিচ্ছেন এমনটা কখনও মনে হয়নি। আমাদের বাড়ির মা-কাকিমারা যে ভাবে হাতে ধরে আমাদের কাজ শেখান, একই রকম ভাবে আমরাও এখানে খেলা শিখি।’’
যাঁকে নিয়ে এত গর্ব সকলের, সেই ভারতী যদিও অন্য স্বপ্নে বিভোর। নিজের সমাজকে অন্য স্তরের পরিচয় দিতে মরিয়া লড়াই তাঁর। ভারতী বলছেন, ‘‘আমি আটপৌরে শাড়ি পরে যেমন দুমদুমির মাঠে মেয়েদের খেলা শেখাই, তেমনই দল নিয়ে কলকাতায় গেলে একই পোশাকে মাঠে নামি। তির্যক মন্তব্য শুনেছি অনেক। কিন্তু খেলার শেষে আমার দলের মেয়েরা প্রমাণ করে দিয়েছে, পোশাক যা-ই হোক না কেন, সদিচ্ছা আর ভালবাসায় বাধার পাহাড়কেও পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব।’’
এই জেদ নিয়েই তিনি শাড়ি পরা কোচ। কোচ আরও অনেকেই হন। কিন্তু শাড়ি পরে ফুটবল শিখিয়ে চলাটাই ভারতীর অ-সাধারণ ‘আইডেন্টিটি’।