পারিবারিক ঘটনাপ্রবাহের জেরে বাড়ি ছেড়ে, বাবা-মাকে ছেড়ে অনেক দূরের আশ্রমে চলে যেতে হয়েছিল। সেই কিশোরই, সেই আশ্রমিক যাপন থেকে পাওয়া অনুভূতির উপর দাঁড়িয়ে এখন বহু জনের আশ্রয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পারিবারিক ঘটনাপ্রবাহের জেরে বাড়ি ছেড়ে, বাবা-মাকে ছেড়ে অনেক দূরের আশ্রমে চলে যেতে হয়েছিল। কিশোরমন প্রথমে সেটা একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। তিনটে বছর যেন কেটেছিল তিরিশ বছরের মতো দীর্ঘ সময় নিয়ে। তবে সে সবের মধ্যেও কী একটা যেন জন্ম নিচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। সেই কিশোরই, সেই আশ্রমিক যাপন থেকে পাওয়া অনুভূতির উপর দাঁড়িয়ে এখন বহু জনের আশ্রয়।যাঁদের কেউ নেই, তাঁদের অপা আছে!অপা কে? এ প্রশ্নের উত্তর জানে অনাথ আশ্রমের ওই শিশুরা। এ প্রশ্নের উত্তর জানেন বৃদ্ধাশ্রমের সেই সব আবাসিকেরা। এ প্রশ্নের উত্তর জানেন ভাঙন দুর্গতেরা। এ প্রশ্নের উত্তর জানে অসংখ্য পথশিশু, জানেন ভবঘুরে ও মানসিক ভারসাম্যহীনেরা। অর্পণ বন্দ্যোপাধ্যায় কবে যে এঁদের কাছে অপা হয়ে উঠেছেন, তা জানেন না বছর বিয়াল্লিশের যুবক। তামাম দুনিয়া তাঁকে অপা নামেই চেনে।
বাড়ি নদিয়ার করিমপুরে। বাহন, লাল রঙের স্কুটি। নেশা, দুধ চা আর ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’। যদিও এই প্রবাদে প্রবল আপত্তি অর্পণের। অপার প্রশ্ন, ‘‘যাঁরা অসহায়, যাঁরা বিপদের মধ্যে আছেন, তাঁদের ‘বনের মোষ’ বলাটা কি ঠিক?’’অতএব, বাহনে চেপে অর্পণ ছুটছেন সকাল থেকে রাত্রি। এই তো সে দিনের কথা। দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর অনাথ আশ্রমের বৃদ্ধ মাস্টারমশাই খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছিলেন। ক’দিন ধরেই চাল বাড়ন্ত। অর্থাভাবও প্রবল। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ঠিক সেই সময় আশ্রমে পৌঁছল একটি গাড়ি। তাতে রয়েছে চাল, ডাল, বাচ্চাদের খাবার, পোশাক, আরও কত কী! করিমপুর থেকে বুনিয়াদপুরের সড়কপথে দূরত্ব প্রায় ২৭৫ কিলোমিটার। অর্পণকে দেখে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি ৯৪ বছরের মাস্টারমশাই। জড়িয়ে ধরেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘ঈশ্বর এখনও আছে। নইলে এমনটাও হয়!’’অর্পণও এ সব দৃশ্যে চোখের জলে ভিজে যান। বলছেন, ‘‘ওঁর আশ্রমের কথা শুনে আমিও চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। মানুষের পাশে দাঁড়ানো যে কী আনন্দের তা বলে বোঝানো কঠিন। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা নিমিত্তমাত্র। মানুষই জুটিয়ে দেন। আর মিলিয়ে দেন উপরওয়ালা!’’
নিজস্ব চিত্র।
গোটা করিমপুর জানে, গত প্রায় ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে অর্পণ এমন কাজকর্মই করে চলেছেন। অনাথ আশ্রমের আবাসিকদের নিয়ে পিকনিক, শীতকালে ভবঘুরে, মানসিক ভারসাম্যহীন ও দরিদ্রদের জন্য শীতবস্ত্র জোগাড় করে বিলি, প্রতিবন্ধীদের ট্রাই সাইকেলের ব্যবস্থা করা, অভাবি পড়ুয়াদের বই কিনে দেওয়া— এ তালিকা বেশ দীর্ঘ। এই যেমন করোনাকালে অপা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন, ‘কোনও বাড়িতে যদি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকেন এবং তাঁদের যদি ওষুধ এনে দেওয়া বা বাজার করার কেউ না থাকে তা হলে আমাকে ফোন করতে পারেন।’ সঙ্গে পোস্ট করেন নিজের মোবাইল নম্বরও। আর যাঁদের ফেসবুক ছিল না, স্থানীয় দোকানপাট বন্ধ থাকলে যাঁদের পেট ভরত না, সেই সব ভবঘুরে ও মানসিক ভারসাম্যহীনদের কাছে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন রান্না করা খাবার। এক-দু’দিন নয়, গোটা লকডাউন পর্বটা অপা পাশে ছিলেন।
নদিয়ার করিমপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর, সুন্দরবনের সূর্যনগরের অনাথ আশ্রমের শিশুদের কাছে তিনি ‘অপাকাকা’। বেতাই ও রামঘাট বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকের কাছে তিনি ‘অপাবাবা’। সুন্দরবনের মৌসুনি দ্বীপ, পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরি, মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জে তিনি ‘মুশকিল আসান’। দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দা লুনা পাল সেই সময়কার কথা মনে করিয়ে বলছেন, ‘‘বাবা-মা দু’জনেই করিমপুরে। তাঁদের বয়স হয়েছে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। লকডাউনের সময় আমি ও ভাই দু’জনেই কলকাতায়। হঠাৎ ফেসবুকে অর্পণদার পোস্ট দেখে স্বস্তি পাই। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করি। বিশ্বাস করবেন না, আধ ঘণ্টার মধ্যে অর্পণদা বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দিয়েছে।’’
নদিয়ার করিমপুর, দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর, সুন্দরবনের সূর্যনগরের অনাথ আশ্রমের শিশুদের কাছে তিনি ‘অপাকাকা’। নিজস্ব চিত্র।
এ সবের জন্য তো ভালমতো টাকা খরচ হয়। সে টাকা জোগাড় হয় কী ভাবে? পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অর্পণ বলছেন, ‘‘প্রথমে শুরুটা করেছিলাম নিজের সাধ্য মতো। তার পরে করিমপুরের বহু ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত। সব মিলিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তবে একটা কথা স্পষ্ট বুঝি, সদিচ্ছাটাই আসল। খুব ইচ্ছে আছে, করিমপুরে একটা বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার। মৃত্যুর আগে সেটা করতে পারলেই বিরাট শান্তি পাব।’’ নিজের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও কোনও রাখঢাক নেই অর্পণের। তাঁর কথায়, ‘‘আমার নিজের পছন্দের রাজনৈতিক দল আছে। কিন্তু আমার কাজের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।’’অর্পণের কাজকর্ম দেখে অনেক রাজনৈতিক নেতা নাকি ‘হীনন্মন্যতা’য় ভোগেন। নানা ভাবে হুমকিও এসেছে। কেউ কেউ কটাক্ষ করে বলেছেন, দু’পয়সার চালডাল দিয়ে তিনি নেতা হতে চাইছেন। সে সব শুনে অর্পণের প্রতিক্রিয়া, ‘‘বুঝুন কাণ্ড! আমার নেতা হওয়ার বাসনা নেই। কিন্তু নেতারা ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজেদের প্রচার না করে কিছু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ালে দেশের হতশ্রী চেহারাটাই বদলে যাবে। এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি।’’ বাড়িতে বাবা, মা, দাদা, বৌদি আর ভাইঝি। বাবাও ছোটখাটো ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু বাড়ির ছোট ছেলের এ সব কাজে তাঁদের প্রশ্রয়ই রয়েছে। আসলে জীবনের ওই তিনটে বছরই সব পাল্টে দিয়েছিল অর্পণের। প্রথমে হয়তো কিশোরবেলার ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল কেমন। অগোছালো সেই সব ভাবনাই অনেক পরে যে এমন ভাবে জুড়ে যাবে, তখন সে সব মাথাতেও আসেনি। কিন্তু অঙ্কুরোদ্গমটা টের পাচ্ছিল বছর বারোর সেই কিশোর।
গোটা করিমপুর জানে, গত প্রায় ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে অর্পণ এমন কাজকর্মই করে চলেছেন। নিজস্ব চিত্র।
এখনও অবিবাহিত অর্পণের কথায়, ‘‘তখন আমার বয়স ১২। পারিবারিক কারণে আমাকে হালিশহরের একটা আশ্রমে থাকতে হয়েছিল প্রায় তিন বছর। ওই তিনটে বছর আমার কাছে তিরিশ বছরের সমান। তখন দেখেছি, আশ্রমের জীবন কেমন! নিজের লোকজন ছেড়ে আশ্রমে থাকার অভিজ্ঞতা কতটা ভয়ঙ্কর, তা জেনেছিলাম সেই সময়টায়। আর যাদের নিজের লোকই নেই, তাদের কাছে অপর একটা হাত কতটা যে ভরসার, সেটাও কিন্তু ওই সময়েই উপলব্ধি করেছি। তখন থেকেই তিল তিল করে অন্যের পাশে থাকার ইচ্ছেটাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। একটা সময়ে এসে সেই ইচ্ছেটাকেই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি। খুব আনন্দ হয়।’’অপা তাই বলেন, ‘‘সকলকে শুধু একটা কথাই বলতে চাই, সুসময়ে ভাল থাকুন, অসময়ে আমি আছি।’’