হাতে হাত রেখে ব্যারিকেড গড়াটাই প্রতি দিনের কাজ। এ লড়াই জিততে মরণপণ করেছেন বেলুড়ের সুস্মিতা নাথ।
হাতে হাত রেখে ব্যারিকেড গড়াটাই প্রতি দিনের কাজ। কারণ, লড়াই প্রতি দিনের। আর এ লড়াই জিততে মরণপণ করেছেন বেলুড়ের সুস্মিতা নাথ। তবুও মাঝে মাঝে এক-দু’টো করে তারা খসে যায় যুদ্ধাকাশ থেকে। তা-ও লড়াই চালিয়ে যান সুস্মিতা। তিনি সেনাপতি। আবার তিনিই রণক্ষেত্রে সৈনিক।
সুস্মিতা তখন চতুর্থ শ্রেণি। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌড়নোর সময় আলটপকা মাথা ঘুরে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান। ভর্তি করা হয় শিশুমঙ্গল হাসপাতালে। রক্তের রিপোর্ট জানায় টাইফয়েড। একই সঙ্গে বছর আটেকের বালিকার শরীরে ধরা পড়ে থ্যালাসেমিয়া। বাঁচানোর আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু লড়াই তো তার রক্তে থ্যালাসেমিয়ার মতোই মিশে রয়েছে। বছর তিরিশ আগের সেই মুহূর্ত থেকেই লড়াইয়ের শুরু। এখনও চলছে।
তবে সুস্মিতা এ লড়াইয়ে একা নন। যুদ্ধমঞ্চে সেনাপতির সঙ্গে কয়েক’শো সেনা। সবাই লড়ছে। একসঙ্গে। সবাই বাঁচতে চাইছে। একসঙ্গে। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। তবে সুস্মিতার কাছে এ লড়াই আরও এক পর্দা উঁচুতে— যুদ্ধ। বাঁচানোর যুদ্ধ।
এই লড়াই সুস্মিতা প্রতি দিন জিততে চান। তাঁর কথায়, ‘‘থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে এখনও বহু মানুষ সচেতন নন।
বেলুড়ের লালা বাবু শায়র রোডে বাড়ি সুস্মিতার। ছোটবেলা থেকে বরাবর প্রত্যেক ক্লাসেই প্রথম হওয়া ছাত্রী। থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ার কয়েক বছরের মধ্যেই মা চলে যাবেন ক্যানসারে। তার পর রেলকর্মী বাবাও পঙ্গু হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী থাকবেন। কিন্তু সুস্মিতা লড়াইয়ের মঞ্চে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকবেন। যেমনটা এখনও আছেন। সুস্মিতার জন্মের আগেই তাঁর দাদা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। দিদিও থ্যালাসেমিয়া-আক্রান্ত। তবে তাঁর কোনও লক্ষণ নেই। আপাতত বাবা-দিদি-জামাইবাবুকে নিয়ে সুস্মিতার ছোট সংসার। আর বৃহৎ সংসার বাড়ির বাইরে ছড়িয়ে। সেই পরিবারের জন্যই সর্ব ক্ষণ নিবেদিতপ্রাণ সুস্মিতা— লড়াইটাও তো প্রাণ বাঁচানোরই।
থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ার পর থেকে মাসে দু’বার করে রক্ত নিতে হয় সুস্মিতাকে। সঙ্গে অন্য ওষুধ। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক ভাবে থাকার কথা ১৪। কিন্তু সুস্মিতার শরীরে কখনও কখনও সেটা নেমে যেত ২-এ। সেই শরীর নিয়েই পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। আইসিএসই থেকে স্নাতক স্তর— দারুণ রেজাল্ট। পড়াশোনার পাশাপাশি চালিয়ে গিয়েছেন থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে সচেতনতার পাঠ। প্রাইভেট টিউশন থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে নিজের ওষুধ কেনার পাশাপাশি অন্য অসহায় রোগীদের সাহায্য করতেন। মেধাবী ছাত্রীর অনেক কাজের সুযোগ থাকলেও তিনি শুধু থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য কাজ করতে চেয়েছেন। তাই মাস্টার অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার (এমএসডব্লিউ) কোর্স করা। এখন এনআরএসে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ‘হিমোগ্লোবিনো প্যাথি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’-এ ‘কাউন্সেলিং’ করেন। চুক্তিভিত্তিক চাকরি। তবে সেই চাকরিটাও ভালবাসেন সুস্মিতা। বলেন, ‘‘আমার লড়াইটা ভীষণ কঠিন। ১৫ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছি। দাদাকে দেখিইনি। বাবা পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী। কিন্তু অনেক মানুষ আমাদের চারপাশেই আছেন যাঁদের লড়াই আরও, আরও কঠিন। তাঁদের লড়াইটাকে নিজের মনে করে নিয়েছি। তাতে নিজের লড়াইটা অনেক লঘু লাগে।’’
এই লড়াই সুস্মিতা প্রতি দিন জিততে চান। তাঁর কথায়, ‘‘থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে এখনও বহু মানুষ সচেতন নন। এই অসুখ যে কতটা যন্ত্রণার, যাঁদের হয় তাঁরাই বোঝেন।’’ তাই রক্ত পাওয়া নিয়ে কারও সমস্যা হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজের টাকায় ওষুধ কিনে দেন। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের সমস্যার সমাধার করার চেষ্টা করেন। কোন ডাক্তারের সঙ্গে তাঁরা কথা বলবেন, কোথা থেকে রক্ত পাবেন, কোন ওষুধ কোথায় পাওয়া যাবে, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তরা করোনার প্রতিষেধক নিতে পারবেন কি না তা নিয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে ক্রমাগত আলোচনা করা, কোথায় করোনার টিকা মিলবে— সবই তাঁর কাজের অঙ্গ।
ভালবেসে সুস্মিতার বৃহৎ পরিবারের অনেকে তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকে।
বছরখানেক হল সুস্মিতাকে আর রক্ত নিতে হয়নি। কিন্তু শরীরের অন্যান্য সমস্যা বেড়েছে। বলছিলেন, ‘‘আগে মাসে দু’বার রক্ত নিতে হত। ম্যালেরিয়া হয়েছে। হেপাটাইটিস সি থেকে সেপ্টিসেমিয়া— মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছি। বছরখানেক হল রক্ত নিতে হয়নি। একটা ওষুধ আমার শরীরে ভাল কাজ করছে। কিন্তু এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। এখন একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে যাই। থাইরয়েডটাও বেড়েছে। মনের জোরে রোজ হাসপাতাল যাই। এই কার্যত লকডাউনেও। না গেলে ভাল লাগে না। আমার অপেক্ষায় থাকেন যে ওঁরা।’’ ওঁরা হাসপাতালে ভর্তি বা চিকিৎসা করাতে আসা থ্যালাসেমিয়া রোগী। রবিবার বাদে প্রতি দিন সকাল ৯টা থেকে হাসপাতালে থাকেন সুস্মিতা। বলছিলেন, ‘‘ওদের মধ্যে কত ছোট ছোট বাচ্চা আছে। দেখে নিজের ছোটবেলাটা মনে পড়ে যায়। ওরাই তো আমার সন্তানসম।’’
ভালবেসে তাঁর বৃহৎ পরিবারের অনেকে সুস্মিতাকে ‘মা’ বলে ডাকে। ‘‘আমি ওদের বকাঝকা, আদর, ভালবাসা সবেতেই ভরিয়ে রাখি। মা ডাকটা শুনলে ভিতরটা কেমন নড়ে যায়’’— বলছিলেন সুস্মিতা। বিয়ে করেননি। এখনও পর্যন্ত ভাবনা, করবেন না। তাঁর কথায়, ‘‘কী ভাবে করব! এত বড় পরিবার সামলাতে গিয়ে নিজের সংসার সামলানো খুব একটা সহজ হবে না বুঝি যে। আর থ্যালাসেমিয়া রোগীর বিয়ে করার কথা ভাবার আগে একটু ভাবনাচিন্তাও করা দরকার। কারণ স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বাহক হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ২৫ শতাংশ। জিনগত সমস্যা তো! তবে বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করিয়ে নিলে সমাধানের রাস্তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রেই যেমন। দাদা আমার জন্মের আগেই মারা গেল। দিদিও আক্রান্ত। তবে সমস্যা নেই। আমিও তো থ্যালাসেমিয়ার রোগী।’’
সুস্মিতার যুদ্ধে ‘নেগেটিভ’ বিষয়ও আছে। আছে কিছু হেরে যাওয়ার ইতিহাস। সেগুলো মাঝেমধ্যে কষ্ট দেয়, কাঁদায়, ভাবায় সুস্মিতাকে। মোবাইলে থেকে যায় কিছু মেসেজ। কিছু ছবি। কিছু নম্বর। খসে-যাওয়া তারাদের স্মৃতি।
হাতে হাত রেখে ব্যারিকেড করেন সুস্মিতা। লড়াই আর দৃঢ়চিত্তের দিব্যি।