ইভিএম প্রসঙ্গে সচেতন করছেন জহর সরকার। ছবি: সুমন বল্লভ
আগে প্রশ্নটা আসে কিছু রাজনৈতিক দল বা নাগরিক অধিকার রক্ষা মঞ্চের তরফে। এ দেশের নির্বাচন কমিশন তাতে কার্যত দৃকপাত করেনি। এ বার ভোটযন্ত্রে জনমত বা রায়ের সৎ, স্বচ্ছ প্রয়োগ নিয়ে প্রযুক্তি বিশারদদের তরফেও আপত্তি উঠে এল। প্রাক্তন আমলা, বিচারপতি, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে গঠিত মঞ্চ সিটিজ়েন্স কমিশন অন ইলেকশনস (সিসিই)-এর তরফে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিষয়টি মেলে ধরা হয়েছে। সামনেই পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের পাঁচটি রাজ্যে ভোট। এই পটভূমিতে, সাধারণ ভোটারকে ভরসা দিতে ভোটযন্ত্র (ইভিএম) জরিপ করার পাশাপাশি পরিস্থিতি অনুযায়ী সব ক’টি ভিভিপ্যাট (ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল বা ভোটযন্ত্রে বন্দি জনমতের কাগুজে নথি) গুনতিও দরকার বলে সিসিই-র রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে।
ভোটযন্ত্রের নিশ্ছিদ্রতা নিয়ে রিপোর্টটি (https://www.reclaimtherepublic.co/report) শনিবার প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লি আইআইটি-র কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক সঞ্জীবা প্রসাদের তত্ত্বাবধানে বিষয়টি নিয়ে চর্চা করা হয়। এ দেশের ইভিএমের প্রযুক্তিগত গঠন ও প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাইলেও অবশ্য সাড়া মেলেনি বলে সিসিই-র দাবি। তবে সিসিই-র বিশেষজ্ঞেরা গোটা বিষয়টি নিয়ে কয়েক জন সর্বোচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের মত যাচাই করেছেন। তাঁদের মধ্যে এমআইটি-র কম্পিউটারপ্রযুক্তি বিশারদ রোনাল্ড এল রিভেস্ট, ইউনিভারসিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রাশিবিজ্ঞান বিশারদ ফিলিপ বি স্টার্ক, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইবার সুরক্ষা বিভাগের অধ্যাপক ভ্যানেসা টেগু প্রমুখ রয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের তরফে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করা হয়নি। তবে এ বারও সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন রাজ্যে ভোট হবে বলে কমিশন সূত্রে কোনও আশঙ্কাকেই আমল দেওয়া হচ্ছে না।
সিসিই-র তরফে আইআইটি দিল্লি-র কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক শুভাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেন, ‘‘কোনও যন্ত্রই হ্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ সুরক্ষিত তা দাবি করা যায় না। আধুনিকতম কম্পিউটারের সুরক্ষা ব্যূহও ভেদ করা যায়। চাইলে ভোটের দু’মাস আগেও কোনও যন্ত্রের ভেতরে কারচুপির ফাঁদ পাতা সম্ভব।’’ কিন্তু এ দেশে ব্যবহৃত ভোটযন্ত্রের গলদ ঠিক সেই জন্যও নয় বলে শুভাশিসবাবুর অভিমত। তিনি বলেন, ‘‘ভোটটা পছন্দসই জায়গায় পড়ছে কি না, সে-বিষয়টা যাচাই করার বন্দোবস্তেও যথেষ্ট ত্রুটি। এবং এর পিছনেও ভোটযন্ত্রের গঠনের ত্রুটি দায়ী।’’ কী ভাবে? বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, পুরো পদ্ধতিটি ‘ভোটার ভেরিফায়েবল’ নয়। এখনও পর্যন্ত যন্ত্রে বোতাম টিপে ভোট দিয়ে বড়জোর সাত সেকেন্ডের জন্য ভোটটা ঠিক জায়গায় পড়ল কি না, দেখার ব্যবস্থা আছে। এই সাত সেকেন্ড সময়টা সব নাগরিকের জন্য পর্যাপ্ত না-ও হতে পারে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, একমাত্র ভোটার কাগুজে নথি হাতে নিয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারলে এবং সেই নথি গোনা হলেই প্রক্রিয়াটি পুরো স্বচ্ছ বলা যায়। ইতিমধ্যে ভোটযন্ত্রে তাঁর ভোট ঠিক জায়গায় পড়েনি বলে কিছু অভিযোগ মিলেছে। কিন্তু যন্ত্রের গঠনগত কারণেই তা যাচাই করা যায়নি।
ভিভিপ্যাট গুনতির উপযোগিতা বা ভোটযন্ত্র ব্যবহারের বিভিন্ন ধাপ নিয়ে অবশ্য আগেই হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টে নানা মামলা হয়েছে। তার পরে প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্র পিছু পাঁচটি করে ভিভিপ্যাট গুনতি ধার্য হয়। সিসিই-র প্রতিনিধিদের মতে, সদ্য সমাপ্ত বিহার বিধানসভার বেশ কয়েকটি কেন্দ্রের মতো যেখানে মাত্র কয়েকটি ভোটে ফয়সালা হচ্ছে, সেখানে দরকারে সব ক’টি ভিভিপ্যাটই গুনতি দরকার। সিসিই-র রিপোর্ট প্রকাশের প্রাক্কালে এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক তথা অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার জহর সরকারও এ দিন ভিভিপ্যাট গুনতির হয়েই সওয়াল করেছেন। তিনি বলছেন, ‘‘২০১৯এর ভোটের ভিভিপ্যাট নথি কয়েক মাসের মধ্যেই নষ্ট করা হয়েছিল। কমিশনের ভিভিপ্যাট গুনতে অনীহাও রহস্যজনক।’’ জহরবাবুর কথায়, ‘‘ভিভিপ্যাট গোনা ও সাবেক ব্যালট গোনায় বিরাট ফারাক। ভিভিপ্যাট গুনতি নগদ টাকা গোনার মতো সহজ। ইভিএম এবং ভিভিপ্যাট দু’টো মেলানো তেমন ঝামেলার নয়।’’
কমিশন সূত্রের অবশ্য দাবি, ইভিএম নিয়ে এতশত আশঙ্কা অমূলক। নতুন যে মেশিনগুলি এসেছে, তাতে কিছু পরিবর্তন করতে গেলেই ইভিএম কাজ করা বন্ধ করে দেবে। ফলে ভোট প্রভাবিত করার সম্ভাবনা নেই। বিভিন্ন হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টেও ইভিএম-এর কার্যকারিতার স্বীকৃতি মিলেছে।
কমিশন সূত্র জানাচ্ছে, এমনিতে জিপিএস লাগানো গাড়িতে ইভিএম নিয়ে যাওয়া হয়। তা খোলা হয় রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সামনে। সেই প্রক্রিয়ার ভিডিয়োগ্রাফ হবে। দফায় দফায় ভিডিয়োগ্রাফ, ওয়েবকাস্টিং এবং সিসিটিভ ফুটেজ রাখেন আধিকারিকেরা। ভোটের ফল ঘোষণার অন্তত দেড়মাস পর পর্যন্ত তা সংরক্ষিতও থাকে। সিসিই-র তরফে তবু প্রশ্ন, প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে ইভিএম নেই কেন? জহরবাবু, শুভাশিসবাবুরা বলছেন, ‘‘প্রযুক্তিবিদদের শংসাপত্রের ভরসায় গণতন্ত্র চলে না। যে কোনও নাগরিকের কাছে জলের মতো সোজা পদ্ধতিতে ভোট প্রক্রিয়া হওয়া উচিত।’’