গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
তাঁর সঙ্গে দেখা করতে উলুবেড়ে, মতিহারি, রামকিষ্টপুর বা কাশিমবাজারে যেতে হবে না। এমনকি, আগে থেকে হিসেব করে দেখতে হবে না ‘দাদা কোথায় নেই’, ‘দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে’, ‘দাদা এখন কোথায় আছে’ বা ‘দাদা কোথায় থাকবে’!
তিনি ‘হাসপাতাল দাদা’।
তাঁর একমাত্র ঠিকানা মেদিনীপুর। সেখানকার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে গেলে ‘দাদা’র দেখা মিলবেই। যে কোনও সময়ে। এই করোনা-কালেও।
নাম পঙ্কজ পাত্র। কিন্তু ৬৬ বছরের প্রৌঢ় পরিচিত ‘হাসপাতাল দাদা’ নামেই। ১৯৭৪ সাল থেকে তাঁর যাতায়াত মেদিনীপুর হাসপাতালে। সেই হাসপাতাল তখনও মেডিক্যাল কলেজ হয়নি। আড়েবহরে বাড়েনি। তখনও মেদিনীপুর জেলা অবিভক্ত। তখন থেকেই পঙ্কজ হাসপাতালে আগত রোগীদের নানাবিধ পরিষেবা দেন। ভর্তি থেকে তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ, নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থা থেকে বাড়ির লোকদের খাওয়াদাওয়া— সবেতেই ত্রাতা পঙ্কজ। করোনার প্রথম থেকে দ্বিতীয় ঢেউ— সব পরিস্থিতিতেই তিনি হাসপাতালে হাজির। তবে ইদানীং প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে সপ্তাহে দু’দিন যাচ্ছেন না। রক্তে শর্করার পরিমাণ অনেক বেশি।
তবে নিজের শরীর নিয়ে আর কবেই বা ভেবেছেন ‘হাসপাতাল দাদা’।
মেদিনীপুর সদর ব্লকের পাথরা অঞ্চলের মালিদা গ্রামে বাড়ি। পাঁচখুরির হাট থেকে পাঁচ কিলোমিটার। হাসপাতাল থেকে সব মিলিয়ে কিলোমিটার ১২ হবে। বয়স তখন ১৯। গ্রামের এক অসুস্থকে ভর্তি করতে পঙ্কজ এসেছিলেন মেদিনীপুর হাসপাতালে। সেই অসুস্থের সেবা-যত্ন করতে করতেই হাসপাতালের প্রেমে পড়ে যান। চেনা-অচেনা সব রোগীদেরই সাহায্য করতে এগিয়ে যান তিনি। ১৯৭৬ সালে সমবায় দফতরের বিপণন বিভাগে একটা কাজ জুটে গিয়েছিল। কিন্তু হাসপাতালের চেয়ে চাকরির টান বেশি মনে করেননি কখনও। সকালে বাড়ি থেকে কাঁধের ঝোলায় মুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সঙ্গে গ্লাভস, মাস্ক আর স্যানিটাইজার। সারা দিনের কাজ বলতে হাসপাতালের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়ানো— কে কোথায় ভর্তি হলেন। তাঁর কী প্রয়োজন। কোন বিভাগের ডাক্তার তাঁকে দেখবেন। ওষুধপত্র সব ঠিকঠাক আছে কি না। কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে কি না।
অসুস্থ বৃদ্ধকে ওয়ার্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন ‘হাসপাতাল দাদা’। —নিজস্ব চিত্র
প্রথম প্রথম সাইকেলে চেপেই যেতেন হাসপাতালে। বছর ১৫ আগে একটা মোটরসাইকেল কিনেছেন। সকাল ৯টার মধ্যে সেই মোটরসাইকেলে চেপে হাসপাতালে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল। মামার বাড়ি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পরিবার। বাবার বাড়ির দিক থেকেও সম্পত্তি কম ছিল না। বলছিলেন, তাঁদের পরিবারের ১০৫ একর জমি খাস হয়ে গিয়েছে। সারা জীবনে রোজগার বলতে তেমন কিছু ছিল না। তবে দুই ছেলের পড়াশোনায় খামতি রাখেননি। বড় ছেলে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। ছোট ছেলের পোল্ট্রির ব্যবসা বাড়িতেই। সামান্য চাষবাসও করেন। দুই ছেলেই সংসার চালান। বাবাকে হাতখরচও দেন। সেই পয়সাতেই এখন রোগীর সেবা করেন পঙ্কজ। ‘হাসপাতাল দাদা’-র কথায়, ‘‘সেবা করতে তেমন পয়সা লাগে না তো! কাউকে কাউকে হয়তো ওই জেরক্স করার পয়সাটা দিতে হয়। ইদানীং হাসপাতালে টিকিট হয়েছে। তার দু’টাকা। আর সামান্য খাবারদাবার বা ওষুধপত্র। সেটা তো খুব বড় ব্যাপার নয়। বড় ব্যাপার হল মানুষের পাশে থাকা। সেটাই চেষ্টা করে যাই। এটুকু করতে কারও কাছে হাত পাততে হয় না। কোনও দিন পাততে হয়ওনি।’’
নিজেও একটা সময় চাষবাস করেছেন। কংগ্রেস করতেন। ১৯৭৭ থেকে বেশ কয়েক বার জেলা পরিষদের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। জিততে পারেননি। তবে কোনও আফসোস নেই। এ বারের বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলে যোগ দেন। কিন্তু কোনও কাজ করেননি। সটান বললেন, ‘‘দলটা ভাল লাগেনি। তাই কোনও কাজও করিনি। তবে খাতায়কলমে আছি তৃণমূলে।’’ ব্যক্তিজীবনে রাজনীতিতে উৎসাহ থাকলেও তার ছোঁয়াচ লাগতে দেননি হাসপাতালের কাজে। সেখানে তাঁর কাছে সকলেই আর্ত। বলেন, ‘‘সব দলের লোকজনই আমায় ফোন করে বলেন, হাসপাতাল দাদা, অমুক ভর্তি একটু দেখবেন। দাদা তমুকের কোনও চিকিৎসা হচ্ছে না। পড়ে আছে। একটু দেখুন। সকলের সবটাই দেখি। রাজনীতি দেখলে মানুষের সেবাটাই তো করা যাবে না।’’
হাসপাতালে কোথায় কোন ডাক্তার বসেন, ইমার্জেন্সি কোথায়, এক্স রে বা অন্যান্য পরীক্ষানিরীক্ষার খুঁটিনাটি পঙ্কজের নখদর্পণে। স্ট্রেচারে রোগীকে বয়ে ওয়ার্ডেও নিয়ে গিয়েছেন একাধিক বার। ভাল লাগে। বলেন, ‘‘ভাল লাগে মানুষের সেবা করতে। ডাক্তারবাবু, হাসপাতাল কর্মীদের প্রায় সকলেই চেনেন। লকডাউনের সময় লোকের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে মাস্ক-স্যানিটাইজার দিয়েছি রোগীর আত্মীয়দের। শুকনো খাবারও। এখন আবার সেটা শুরু করেছি। এ বার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।’’
কাজ ফুরলে তাঁকে কেউ মনে রাখে?
প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই থামিয়ে দেন পঙ্কজ, ‘‘কী বলছেন! ওঁরা ভুলে যাবেন আমাকে! দুর্ঘটনায় আহত মুমূর্ষু মানুষ যখন হাসপাতালে আসেন, কেউ তখন তাঁর পরিচয়টাও জানেন না। দেখভাল করে সুস্থ হওয়ার পর বাড়ির ঠিকানা জেনে, যোগাযোগ করে সুস্থ মানুষটিকে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার পর সে ভুলে যাবে কী করে! এমন কত কত মানুষের সঙ্গে এখনও আমার যোগাযোগ আছে।’’ তাঁর কাজে স্ত্রী, পরিবারের সায় আছে। বরাবর। ‘হাসপাতাল দাদা’-র কথায়, ‘‘১৯৭৪ সাল থেকে এই কাজটা করি। বিয়ে করেছি তো ১৯৮২ সালে। ওরা আবার কী বলবে! আমাকে জেনেবুঝেই তো এত বছর কাটিয়ে দিল আমার সঙ্গে। স্ত্রী বা ছেলেদের সায় না থাকলে এত বছর এমন ভাল-লাগা কাজের সঙ্গে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম?’’
হাসতে হাসতে বলে স্ট্রেচার ঠেলে অসুস্থ বৃদ্ধকে ওয়ার্ডের দিকে নিয়ে চলে গেলেন ‘হাসপাতাল দাদা’।