হু হু করে জল ঢুকছে বেসমেন্টে! ছবি: এক্স (পূর্বতন টুইটার)।
বেসমেন্টে লাইব্রেরি কেন? কেন লাইব্রেরি অন্যান্য শ্রেণিকক্ষগুলির মত উপরের তলায় নয়? দিল্লির কোচিং সেন্টারে তিন ছাত্রের মৃত্যুর পর উঠে আসছে এমনই নানা প্রশ্ন।
শনিবার দিল্লির রাজেন্দ্রনগরে কোচিং সেন্টারের বেসমেন্টের জমা জলে ডুবে মৃত্যু হয় তিন পড়ুয়ার। তাঁরা আইএএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শনিবার সন্ধ্যায় কোচিং সেন্টারের বেসমেন্টে লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন ওই পড়ুয়ারা। সেখানেই আচমকা ঢুকতে শুরু করে বৃষ্টির জল। অনেকে বেরিয়ে গেলেও তিন জন বেরোতে পারেননি। তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বেসমেন্টেই। মৃত পড়ুয়ারা হলেন, তানিয়া সোনি (২৫), শ্রেয়া যাদব (২৫) এবং নেভিন দালউইন (২৮)। ঘটনার পর থেকেই ওই কোচিং সেন্টারের সামনে দফায় দফায় বিক্ষোভ দেখিয়েছেন ছাত্রেরা।
ওল্ড রাজেন্দ্রনগরের ওই কোচিং সেন্টারের বেসমেন্ট বেআইনি ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছিল বলে অভিযোগ। জানা গিয়েছে, ২০২১ সালের অগস্ট মাসে দিল্লি পুরসভার কাছ থেকে কোচিং চালানোর অনুমতি পেয়েছিল ওই সংস্থা। সেই সংক্রান্ত নথিতে লেখা রয়েছে, বেসমেন্ট শুধু গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া গৃহস্থালির জিনিসপত্র গুদামজাত করা যাবে সেখানে। পুরসভার অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও কেন সেখানে লাইব্রেরি তৈরি হল? প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও। জানা গিয়েছে, চলতি মাসেই দিল্লির দমকল দফতরের কাছ থেকে ছাড়পত্র পেয়েছিল ওই কোচিং সেন্টার। সেই সংক্রান্ত নথিতে বলা হয়েছে, কোচিং সেন্টারটিতে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বেসমেন্ট আবাসনের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। সেই নিয়মের খাতায় যা রয়েছে, তা-ও মানা হয়নি বলে অভিযোগ। নথি বলছে, বেসমেন্টে উপযুক্ত নিকাশি ব্যবস্থা রাখতে হবে। যদি কোনও কারণে বেসমেন্ট ব্যবসার কাজে ব্যবহার করতে হয়, তবে রাখতে হবে ঢোকার এবং বেরোনোর জন্য একাধিক দরজা। কিন্তু রাজেন্দ্রনগরের কোচিং সেন্টারে ওই এক চিলতে বেসমেন্টেই তৈরি করা হয়েছিল লাইব্রেরি। এমনকি, একটি ঘরে ক্লাসও নেওয়া হত। বেসমেন্ট থেকে বেরোনোর জন্য ছিল একটিমাত্র দরজা! অর্থাৎ কোনও বিপদ হলে সহজে বেরোনোরও উপায় ছিল না ভিতরে থাকা ছাত্রদের।
কেন এই বেনিয়ম? বেসমেন্টকে লাইব্রেরি বানানোর কারণ হিসাবে উঠে আসছে নানা তত্ত্ব। প্রথমত, খরচ। প্রতি ক্লাস-পিছু যা আয় হয়, তা লাইব্রেরি পরিষেবা থেকে প্রাপ্ত অর্থের থেকে বেশি। তাই উপর তলার ঝাঁ-চকচকে ঘরগুলি বরাদ্দ শ্রেণিকক্ষ হিসাবে। তা ছাড়া, উপর তলার ঘরগুলির ভাড়াও বেশি। তাই বেসমেন্টে একটা ছোটোখাটো লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলতে পারলেই হতে পারে অনেক টাকা সাশ্রয়!
কম ভাড়ার এই লাইব্রেরিগুলি পছন্দ অনেক ছাত্রেরও। এখানে বসে পড়ার জন্য ঘণ্টাপ্রতি ভাড়াও অপেক্ষাকৃত কম। ফলে নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে আসা অনেক ছাত্র লাইব্রেরিগুলি ব্যবহার করতে পারেন। এগুলি উপর তলায় হলে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেত পরিষেবা বাবদ খরচ। আইএএস পরীক্ষার্থী পঙ্কজ ওঝা সংবাদমাধ্যমকে জানাচ্ছেন, রাজেন্দ্রনগরের এই বহুতলগুলিতে এক তলার ভাড়া ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্তও হতে পারে। কিন্তু বেসমেন্টের ভাড়া সর্বোচ্চ ৩০,০০০ টাকা। বছর আঠাশের পঙ্কজ বলছেন, ‘‘এখানে পড়তে আসা বেশির ভাগ ছাত্রই মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের। মাসে সামান্য ১০০০ টাকার হেরফেরও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বেসমেন্টের ভাড়া কম হওয়ায় অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী সুলভে লাইব্রেরি পরিষেবার দিকে ঝোঁকেন। এখন কোচিং সেন্টারগুলো যদি লাইব্রেরি উপর তলায় করে দেয়, তা হলে ভাড়া বাবদ খরচ বাড়বে প্রতিষ্ঠানের। আর সেই অতিরিক্ত খরচের মাসুল গুনতে হবে আমাদেরই।’’
এই বেসমেন্ট-লাইব্রেরি পরিষেবা ব্যবহারের খরচ কী রকম? জানাচ্ছেন আর এক পড়ুয়া রবিকান্ত দুর্গ। বলছেন, লাইব্রেরি ব্যবহারের জন্য প্রত্যেক ছাত্রকে মাসে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা দিতে হয়। কৃষক পরিবার থেকে আইএএস হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দিল্লি এসেছেন রবিকান্ত। থাকেন ছ’ফুট বাই দশ ফুটের একচিলতে ঘরে, আরও দুই পড়ুয়ার সঙ্গে। ঘরে তিনটি বিছানা পাতার পর তিলধারণেরও জায়গা নেই। একটা পড়ার টেবিল তো দূর অস্ত! ঠিক মতো আলো-বাতাস আসারও উপায় নেই সেই ঘরে। এর চেয়ে লাইব্রেরিতে গেলে খানিক স্বস্তি মেলে। ওই বেসমেন্ট-লাইব্রেরিই তাঁর এক মাত্র পড়ার জায়গা।
ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে দিল্লিতে আপ বনাম বিজেপি তরজা শুরু হয়েছে। এই ঘটনার জন্য আপ সরকারের অব্যবস্থাকেই দায়ী করেছে বিজেপি। আপ মন্ত্রী অতিশী ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। দিল্লির মেয়রের নির্দেশেও তদন্ত শুরু হয়েছে। ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে পুরসভাও। দিল্লি জুড়ে বেআইনি কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে তারা। রাজেন্দ্রনগর এলাকার ১৩টি কোচিং সেন্টার সিল করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। দিল্লি পুরসভার মেয়র শেলী ওবেরয় বলেছেন, ‘‘কোচিং সেন্টারগুলি বেআইনি ভাবে বেসমেন্ট ব্যবহার করছিল। এগুলি সিল করে কর্তৃপক্ষকে নোটিস দেওয়া হয়েছে।’’