লখনউয়ে নিজের অফিসে রূপরেখা বর্মা। —নিজস্ব চিত্র।
মাইলের পর মাইল জুড়ে সর্ষে আর আনাজের খেত। ফুলকপি, টোম্যাটো...। শহিদ চন্দ্রশেখর আজাদের জেলা, ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানের জনক হসরত মোহানির জেলা উন্নাওয়ের আবাদি ফলনও সুখ্যাত। লখনউয়ের এলডিএ কলোনির বাজারে এক বিক্রেতা হাঁকছিলেন, উন্নাও কি সবজি! উন্নাও কি সবজি! দুই যুবক, দেখে মনে হল কলেজ-ছাত্র, ডেকে বললেন, ‘‘ওই নামটা আর নিয়ো না! লোকে কিনতে চাইবে না!’’
১১ মাসে ৮৬টি ধর্ষণ, ১৮৫টি যৌন হেনস্থার অভিযোগ নথিভুক্ত। উন্নাওয়ের এই পরিসংখ্যান লখনউয়ের অটোচালক থেকে চিকনের দোকানি, সকলের মুখে মুখে ঘুরছে। এই কলঙ্ক রাখব কোথায়— ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন প্রত্যেকেই।
দিল্লিতে শীলা দীক্ষিতের সরকারের পতনের পিছনে নির্ভয়া আন্দোলনের বড় ভূমিকা ছিল। যোগী আদিত্যনাথও কি সেই ভয় পাচ্ছেন? ২১৮টি ফাস্ট ট্র্যাক আদালত গঠনের ঘোষণা, শহরে মেয়েদের রাতে বাড়ি ফেরার জন্য পুলিশি সহায়তার আশ্বাস বুঝিয়ে দিচ্ছে, সরকার একটা বার্তা দিতে মরিয়া।
আরও পড়ুন: ‘ভয়ের কিছু নেই, দিল্লি আসুন, কথা হবে’
উত্তরপ্রদেশের ডিজি-র দায়িত্ব এক সময় সামলেছেন এক বাঙালি। আনন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৪ সালে অবসর নিয়েছেন। গোমতীনগরে নিজের বাড়িতে বসে বললেন, ‘‘কোনও সরকারই কিন্তু চায় না, তার আমলে অপরাধের পরিসংখ্যান বাড়ুক। কিন্তু সেটা আবার বহুলাংশে সমস্যা বাড়িয়েও দেয়। দীর্ঘ পুলিশ জীবনে একমাত্র চরণ সিংহ ছাড়া কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে দেখিনি, যিনি বলেছেন, সব ঘটনা নির্দ্বিধায় নথিভুক্ত করুন। ধর্ষণের অভিযোগ এমনিতেই সামনে আসে সবচেয়ে কম। তার পর যদি পরিসংখ্যান নিয়ে হইচই হয়, পুলিশ কিন্তু আরও কম এফআইআর নিতে চাইবে। ভাল পরিসংখ্যান আসলে সত্যিই ভাল কি না, সেটা বোঝা দরকার।’’
আনন্দলাল বরং বেশি উদ্বিগ্ন তেলঙ্গানার এনকাউন্টার নিয়ে। বললেন, ‘‘এটা একেবারেই সমর্থন করা যায় না। ফৌজদারি মামলায় ন্যায়দানের কাঠামো অবিলম্বে মেরামত করা দরকার। ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের ঘোষণা হল, ভাল কথা। পরিকাঠামো প্রস্তুত কি?’’
উন্নাও জেলাটা এমনিতে বরাবর রাজ্যবাসীর কাছে অপরাধপ্রবণ এলাকা বলেই পরিচিত। খুনখারাপি, ডাকাতি লেগেই থাকে। রাজ্য রাজধানী লখনউ আর রাজ্যের আর্থিক ভরকেন্দ্র কানপুরের মাঝামাঝি এই অঞ্চল উন্নয়নের নিরিখেও পিছিয়ে। তার সঙ্গে চামড়ার কারখানা, মাছের ব্যবসা আর চাষজমির একত্র অবস্থান। ফলে নানা ধরনের লেনদেনকে কেন্দ্র করে ঝুটঝামেলা তৈরি হয়। সঙ্গে গোবলয়ের জাতপাতের রাজনীতি তো আছেই।
এই উন্নাওয়েই বছর কয়েক আগে এক সাধুর কথা শুনে মাটির নীচে সোনা খুঁজতে নেমে পড়েছিল পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ। আর এক বিতর্কিত সাধু সাক্ষী মহারাজ এখন এখানকার সাংসদ। গত সপ্তাহেও যিনি কুলদীপ সেঙ্গারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেননি। আনন্দলালের বক্তব্য, পরপর দু’টো ঘটনা শিরোনামে চলে আসায় সকলের নজর এখন উন্নাওয়ে। তার মানে এই নয়, অন্যান্য জেলার ছবি খুব আলাদা। সামগ্রিক ভাবে ভারতীয় সমাজের ছবিটাই আলাদা নয়।
ধর্ষণ, শাসক দলের সঙ্গে অপরাধীদের যোগ বা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন--- বাস্তবিকই নতুন ঘটনা নয়। রূপরেখা বর্মা তবু জোর গলায় দাবি করছেন, আগের সময়ের তুলনায় যোগী জমানায় গুণগত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। রূপরেখা লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য। সেই সঙ্গে ‘সাঝি দুনিয়া’ নামে একটি সংগঠনের কর্ণধার, যারা নির্যাতিতা মেয়েদের হয়ে লড়াই করে। লখনউ শহরের গোল মার্কেট এলাকায় প্রয়াত সাহিত্যিক যশপালের বাড়ির এক অংশে তার অফিস। সেখানে বসেই ৭৬ বছরের রূপরেখা শোনাচ্ছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতা। সত্তরের দশকের শেষ থেকে নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বললেন, ‘‘মেয়েরা কোনও আমলেই সুরক্ষিত ছিল না। ন্যায়বিচারের লড়াইও মসৃণ ছিল না। কিন্তু যোগী সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছেন।’’
উন্নাওয়ের পরিস্থিতিকে সামগ্রিক ভাবে মোদী-যোগী জমানায় সামাজিক হিংস্রতার উদ্গিরণের পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে চান রূপরেখা। ‘‘যে শাসক ক্রমান্বয়ে দেশ জুড়ে হিংসা, বিদ্বেষ, বিভাজনকে উস্কে দেয়, যেখানে অভিযুক্তেরা জামিন পেলে নায়কের অভ্যর্থনা অপেক্ষা করে, সেই পরিমণ্ডলে মেয়েদের উপরে নিগ্রহ বাড়বে, এটাই তো স্বাভাবিক।’’ অনেক দিন পরে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় ফিরেছে। রূপরেখার দাবি, বর্তমান শাসক তিলক (ব্রাহ্মণ), তলোয়ার (ঠাকুর) আর তরাজু-র (দাঁড়িপাল্লা, বণিকের প্রতীক) দল। ফলে দুর্বলের উপরে নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার কথাই ছিল, বেড়েছে। উঁচু জাতেরা, ঠাকুরেরা মনে করছে, তারা যা খুশি করতে পারে। অখিলেশের সময়ে পুলিশের আচার-ব্যবহারে সামান্য হলেও ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল। সে দিন আজ বিগত, দাবি রূপরেখার।
২০০৫ সালে মুলায়ম সরকারের আমলে লখনউ শহরেই কাগজকুড়ানি এক কিশোরী গণধর্ষিত হয়। অভিযুক্ত ছয় যুবক শাসক দলের ঘনিষ্ঠ ছিল। সে বারেও তাদের আড়াল করার চেষ্টা, পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে আগুয়ান মিছিলকে আটকে দিয়ে পুলিশ কমিশনার ১০ দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। ছ’দিনের মাথায় অভিযুক্তেরা ধরা পড়ে। তার পর আর তাদের বাঁচানোর চেষ্টা হয়নি। ঘটনাটি মনে করিয়ে সে দিনের আন্দোলনের নেত্রী রূপরেখা বলেন, ‘‘এই আমলে এমন আন্দোলন করা অনেক কঠিন।’’
উন্নাওই হোক বা গণপিটুনিখ্যাত দাদরি, তারা তো আসলে একই মানচিত্রের দু’টি বিন্দু।