ফাইল ছবি।
পাইকারি বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার আকাশছোঁয়া হওয়ার অন্যতম কারণ পেট্রল-ডিজ়েলের লাগামছাড়া দাম। কিন্তু এখনও পেট্রল-ডিজ়েলে শুল্ক কমিয়ে দাম কমানোর কোনও ইঙ্গিত দিচ্ছে না মোদী সরকার। এ দিকে অর্থ মন্ত্রকের অন্দরমহলে আশঙ্কা, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ ছাপিয়ে যাওয়ার পরে খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার আরও বাড়বে। যা ইতিমধ্যেই আট বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা মানছেন, পেট্রল-ডিজ়েলে শুল্ক কমানো ছাড়া মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরানোর আর কোনও হাতিয়ার আপাতত সরকারের হাতে নেই। কিন্তু সবেধন নীলমণি ওই অস্ত্রটি প্রয়োগের কোনও প্রস্তাবও এখন নেই। আর কেন্দ্রীয় পেট্রলিয়াম প্রতিমন্ত্রী রামেশ্বর তেলি বলেই দিয়েছেন, ভারত নিজে তেলের উৎপাদন না বাড়ালে পেট্রোপণ্যের দামে রাশ টানা যাবে না। কারণ, তেলের ক্ষেত্রে ভারত বিদেশের উপর নির্ভরশীল।
কংগ্রেস আগেই অভিযোগ তুলেছিল, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব থেকে নজর ঘোরাতেই বিজেপি সাম্প্রদায়িক অশান্তিতে উস্কানি দিচ্ছে। মন্দির-মসজিদ বিবাদ জাগিয়ে তুলছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী আজ ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তুলনা টেনেছেন। ২০১৭ থেকে ২০২১--এই পাঁচ বছরে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি ও সাম্প্রদায়িক হিংসার মাপকাঠিতে ভারত ও শ্রীলঙ্কার রেখচিত্র তুলে ধরে রাহুল দেখিয়েছেন, দুই দেশের রেখচিত্র প্রায় একই রকম। রাহুলের বক্তব্য, “মানুষের নজর ঘোরালে বাস্তব তথ্য বদলাবে না। ভারতকে অনেকটাই শ্রীলঙ্কার মতো দেখাচ্ছে।”
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু আজ বলেছেন, “ভারতের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছে। গত ২৫ বছরে যা সর্বোচ্চ। খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার কম হওয়ায় ভারত দু’টি ঝুঁকির সামনে। হয় ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, বেকারত্ব বাড়বে, অথবা খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হারও বাড়বে। সরকারের সমস্ত নীতির নজর এ দিকে হওয়া উচিত।”
অর্থ মন্ত্রকের সূত্রও মানছে, আগামী দিনে খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারও বাড়তে পারে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দায়িত্ব— খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার ৪ শতাংশ, খুব বেশি হলে ৬ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখা। অর্থনীতির মূল্যায়নকারী সংস্থা ইন্ডিয়া রেটিংস-এর মতে, চলতি অর্থ বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার ৬.৯ শতাংশে পৌঁছবে। যা গত ৯ বছরে সর্বোচ্চ। মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ইতিমধ্যেই এক দফায় সুদের হার ০.৪০ শতাংশ অঙ্ক বাড়িয়েছে। ইন্ডিয়া রেটিংসের মতে, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আরও ০.৭৫ শতাংশ অঙ্ক সুদ বাড়াবে। ১.২৫ শতাংশ অঙ্ক পর্যন্তও সুদের হার বাড়তে পারে।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, মে মাসে খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার বাড়তে পারে। জ্বালানি, খাদ্যপণ্যের সঙ্গে আনাজের দামও বাড়ছে। আনাজের দাম প্রায় ২৩ শতাংশ বেড়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৮.৫ শতাংশ। কম বেতন ও বেকারত্বের সমস্যা যোগ হওয়ায় পাইকারি বাজারে আনাজ কেনার পরিমাণও কমে গিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, মোদী সরকার মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরানোর ভার পুরোপুরি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উপরে ছেড়ে দিয়েছে।
গত নভেম্বরে মোদী সরকার পেট্রলে ৫ টাকা, ডিজ়েলে ১০ টাকা উৎপাদন শুল্ক কমিয়েছিল। এপ্রিল থেকে ফের পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বাড়তে থাকায় শুল্ক কমানোর দাবি নতুন করে উঠলেও প্রধানমন্ত্রী এপ্রিলের শেষে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে শুল্ক কমাতে বলেছিলেন। কংগ্রেসের অভিযোগ, সরকার পেট্রল-ডিজ়েলের দাম কমাচ্ছে না। এ দিকে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা করছে। ইন্ডিয়ান অয়েল ২০২১-২২-এ ২৪ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। এর আগে কোনও দিন এত মুনাফা হয়নি।
কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা বলেন, “এক বছরে পেট্রলের দাম ৬৬.১ শতাংশ বেড়েছে। ডিজ়েলের দাম বেড়েছে ৬০.৬ শতাংশ। জ্বালানিতে লুটের ফলে রেকর্ড মুনাফা হচ্ছে।’’ প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরার অভিযোগ, বিজেপি সরকারের কোনও আর্থিক নীতিই মধ্যবিত্ত, গরিব মানুষের জন্য নয়। মধ্যবিত্ত, গরিব এখন আতঙ্কে যে রোজকার খরচের জন্যও দেনা করতে হবে।
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, খুচরো ও পাইকারি, দুই মূল্যবৃদ্ধির হার যে ভাবে মাত্রাছাড়া হয়ে উঠেছে, তাতে প্রয়োজন হলেও বহু ক্ষেত্রে জিএসটি-র হার বাড়ানো যাবে না। যদিও জিএসটি থেকে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ একই জায়গায় রাখতে বহু ক্ষেত্রেই জিএসটি-র হার বাড়ানো উচিত বলে কেন্দ্র ও রাজ্যের আমলারা মনে করছেন। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইয়ের নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিগোষ্ঠী এ নিয়ে আলোচনা করছে। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি যে ভাবে মাথা চাড়া দিয়েছে, তাতে এখন জিএসটি-র হার বাড়ানো মুশকিল।