প্রতিবাদ: সংসদ ভবন চত্বরে গাঁধী-মূর্তির সামনে কংগ্রেস সাংসদদের সঙ্গে পেঁয়াজের দাম নিয়ে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন জামিনে মুক্ত পি চিদম্বরম। রয়েছেন অধীররঞ্জন চৌধুরীও। পিটিআই
কে বলবে, তিনি ১০৬ দিন পরে তিহাড় জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন! কে বলবে, ৭৪ বছর বয়সে তাঁকে জেলে কাঠের তক্তার উপরে বালিশ ছাড়া শুতে হয়েছিল!
১০৬ দিন পরে ব্যাট ধরে রীতিমতো বীরেন্দ্র সহবাগের মতো ঝড় তুললেন পি চিদম্বরম। বুধবার রাতে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরেই বৃহস্পতিবার সকালে সংসদে হাজির হলেন তিনি। প্রথমে পেঁয়াজের দাম নিয়ে গাঁধী-মূর্তির সামনে ধর্না। তার পরে রাজ্যসভায় হাজিরা দিয়ে কংগ্রেসের সদর দফতরে সাংবাদিক সম্মেলন। আগাগোড়া পুরনো ফর্মের চিদম্বরম আজ অর্থনীতি থেকে কাশ্মীর প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে কার্যত দুরমুশ করলেন। অর্থনীতির সঙ্কটে ‘প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা’র পাশাপাশি প্রশ্ন তুললেন ‘সরকারের দিশাহীনতা’ নিয়ে। হুঁশিয়ারি দিলেন, অর্থনীতির প্রতিটি সমস্যা নিয়ে তিনি আরও বিশদে মুখ খুলবেন। প্রশাসন অনুমতি দিলে তিনি জম্মু-কাশ্মীর যেতেও আগ্রহী।
জেলে থাকতেই চিদম্বরম বলেছিলেন, সরকার আসলে চায় না তিনি অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলুন। আজ সরাসরি মোদীকে নিশানা চিদম্বরম বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী অর্থনীতি নিয়ে অস্বাভাবিক রকম নীরব। মন্ত্রীদের তিনি ধাপ্পাবাজি ও তর্জন-গর্জনের দায়িত্ব দিয়েছেন। ফল হল, এই সরকার অর্থনীতির অযোগ্য পরিচালক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’
কারাবাস কি আপনার মনোবলে ধাক্কা দিয়েছে? মুচকি হেসে চিদম্বরমের জবাব, ‘‘আমি বরাবরই মানসিক ভাবে শক্ত ছিলাম। এখন আরও শক্ত। মনে হচ্ছে, শারীরিক ভাবেও আমি আরও শক্তপোক্ত। একটা উদাহরণ দিই। কাঠের তক্তায় বালিশ ছাড়া শুলে আপনার শিরদাঁড়া, ঘাড়, পিঠ শক্তপোক্ত হয়। আমার শিরদাঁড়া এখন আরও মজবুত। আমার ঘাড়, মাথাও আগের থেকে শক্তপোক্ত হয়েছে।’’
চিদম্বরম ফেরায় আজ কংগ্রেসও সরকার-বিরোধিতার মুখ অর্থনীতির দিকে ভালমতো ঘোরাতে পেরেছে। গত কয়েক দিনে কংগ্রেস নেতারা অর্থনীতি বা পেঁয়াজের দামের প্রসঙ্গ তুলেছেন ঠিকই। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা গাঁধী পরিবারের এসপিজি-নিরাপত্তা নিয়েও সুর চড়ানোয় অর্থনীতির প্রশ্নটি একটু লঘু হয়ে পড়েছিল। আজ চিদম্বরম অর্থনীতির প্রশ্নে কংগ্রেসের আক্রমণের ধার ও ভার বাড়িয়েছেন। এসপিজি নিয়েও কংগ্রেসের অবস্থান সুচারু ভাবে পেশ করে চিদম্বরম বলেন, ‘‘সরকার যদি মনে করে গাঁধীদের এসিপিজি নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই, তা হলে সে দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। গাঁধীরা যথেষ্ট মার্জিত ভাবেই বলেছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত যদি এমনটাই হয়, তবে তা-ই হোক।’’
নড়ে বসতে হয়েছে মোদী সরকারকে। চিদম্বরমের সাংবাদিক সম্মেলনের পরেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর অভিযোগ তোলেন, চিদম্বরম জামিনের শর্ত ভেঙেছেন। আইএনএক্স দুর্নীতি মামলায় চিদম্বরমকে জামিন দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের শর্ত ছিল, তিনি তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডি-র মামলা নিয়ে মুখ খুলতে পারবেন না। চিদম্বরম সরাসরি মামলা নিয়ে মুখ না-খুললেও বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘‘মন্ত্রী হিসেবে আমার রেকর্ড, আমার বিবেক একেবারে পরিষ্কার। আমার সঙ্গে কাজ করা অফিসার, শিল্পপতি ও সাংবাদিকেরা যাঁরা আমাকে দেখেছেন, তাঁরা এটা খুব ভাল জানেন। আমার পরিবার ভগবানে বিশ্বাস করে। আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে, আদালত সুবিচার করবে।’’ জাভড়েকরের অভিযোগ, মন্ত্রী হিসেবে নিজের রেকর্ড পরিষ্কার বলে দাবি করে চিদম্বরম আসলে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নাকচ করতে চেয়েছেন। চিদম্বরম অবশ্য বলেছেন, তিনি কখনওই বিচারাধীন মামলা নিয়ে মন্তব্য করেননি।
গ্রেফতারির ঠিক আগে ২১ অগস্ট সন্ধ্যায় কংগ্রেসের সদর দফতরেই সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন চিদম্বরম। আজ সেই দফতরেই তিনি ফিরে আসাতে, দল পুরো মঞ্চটাই চিদম্বরমের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। বুধবার রাতে তিহাড় থেকে বাড়ি ফিরে চিদম্বরম তাঁর আইনজীবী কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির সঙ্গে কথা বলেন। দলের নেতাদের জানান, তিহাড়ে তাঁর সেল খোলা ছিল বলে বেশ ঠান্ডা ছিল। তাই তাঁকে ওভারকোট ব্যবহার করতে হত। জেলের খাবার খেয়ে প্রথম মাসে তাঁর পাঁচ কেজি ওজন কমে যায়। তার পরে বাড়ির খাবারের অনুমতি মেলায় ফের ওজন বাড়ে।
আজ চিদম্বরম শুরুতেই সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘ঠিক ১০৬ দিন পরে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি। গত কাল রাত ৮টায় বেরিয়ে এসে স্বাধীনতার প্রথম শ্বাস নেওয়ার পরে আমি প্রথম প্রার্থনা করেছি কাশ্মীর উপত্যকার ৭৫ লক্ষ মানুষের জন্য। যাঁরা ৪ অগস্ট থেকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিশেষত বিনা অপরাধে বন্দি রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েও আমি চিন্তিত। স্বাধীনতার কোনও বিভাজন হয় না।’’
অর্থমন্ত্রী হিসেবে চিদম্বরমের বাজেট চেনা যেত প্রাচীন তামিল কবি থিরুভাল্লুভারের উদ্ধৃতি দিয়ে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলাটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কি না, এই প্রশ্নের জবাবে আজ সেই থিরুভাল্লুভারকেই উদ্ধৃত করে চিদম্বরম বলেন, ‘‘যারা তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, তাদের সঙ্গে ভাল আচরণ করো। আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতি করব না। কারা করে, সেটা আপনারাই ঠিক করুন।’’