‘রাজপুতানা’ এবং ‘মেবার’ প্রায় সমার্থক। বীর রাজপুত যোদ্ধা জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম এই মেবার। উত্তর পশ্চিমে আরাবল্লি পর্বত, উত্তরে অজমেঢ়, দক্ষিণে গুজরাত এবং দক্ষিণ পূর্বে মধ্যপ্রদেশের মালব্য অংশের মাঝে বিস্তৃত ছিল প্রাচীন মেবার প্রদেশ।
অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত, প্রাচীন ‘মেড়া’ জনজাতির থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল ‘মেড়াপত্ত’। সেই শব্দের প্রচলিত ও সহজ রূপই হয়ে দাঁড়ায় ‘মেবাড়’ বা ‘মেবার’। অষ্টম শতকে বাপ্পা রাওয়ালের হাতে মেবার প্রদেশের পত্তন। এর পর কালের স্রোতে বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সাক্ষী থেকেছে মেবার। যার মধ্যে অন্যতম ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে হলদিঘাটের যুদ্ধ।
হলদিঘাটের যুদ্ধে মুঘল সম্রাট আকবরের কাছে পরাজিত হন মহারানা প্রতাপ। হাতছাড়া হয়ে যায় উদয়পুর এবং কুম্ভলগড়। পরে রানা প্রতাপ গেরিলা যুদ্ধে পশ্চিম মেবার অধিকার করেছিলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ মেবার ফিরে পাননি। পরে তাঁর ছেলে রানা অমর সিংহ যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন মুঘলদের।
দীর্ঘ কয়েক দশকের রাজপুত-মুঘল টানাপড়েনের পরে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে মেবার নিয়ে চুক্তি হয় দুই পক্ষের মধ্যে। মেবার প্রদেশ ফিরিয়ে দেয় মুঘলরা। তবে তার পরিবর্তে মেবারের যুবরাজকে মুঘল দরবারে হাজিরা দিতে হয়। ১০০০ ঘোড়সওয়ার বাহিনীও মুঘলদের দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় মেবার রাজবংশ। মোরি, গহলৌত এবং সিসৌদিয়া-সহ বিভিন্ন রাজপুত গোষ্ঠীর হাতে ১৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসনকাল পেরিয়ে মেবারের উদয়পুর স্টেট ১৯৪৯ সালে ভারতের অংশ হয়।
বর্তমানে মেবার রাজবংশের অন্যতম মুখ হলেন শ্রীজি অরবিন্দ সিংহ মেবার। রাজবংশের এই উত্তরাধিকার এক জন সফল শিল্পপতিও। উদয়পুর প্যালেসে সপরিবার থাকেন অরবিন্দ। ‘এইচ আর এইচ গ্রুপ অব হোটেলস’-এর কর্ণধার অরবিন্দের অন্যতম শখ বিভিন্ন প্রজাতির বাহারি ঘোড়া।
ইংরেজি সাহিত্য, অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক অরবিন্দ পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে গিয়ে হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে উচ্চশিক্ষা করেছেন। পরে তিনি হসপিট্যালিটি সার্ভিস নিয়ে পড়াশোনার জন্য আমেরিকাও গিয়েছিলেন। দেশে ফিরে তিনি প্রথমে তাঁর বাবা প্রয়াত মহারানা ভগবৎ সিংহের ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার পর ভগবৎ সিংহের হোটেল ব্যবসাতেও পা রাখেন অরবিন্দ। আটের দশকের শুরুতে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন উদয়পুরের লেক প্যালেস হোটেলে।
অরবিন্দের স্ত্রী বিজয়ারাজ গুজরাতের কচ্ছের রাজকুমারি। তাঁদের ৩ সন্তান। দুই রাজকুমারি ভার্গবী এবং পদ্মজার বিয়ে হয়েছে দু’টি রাজপরিবারে। ছেলে লক্ষ্যরাজের স্ত্রী নিবৃত্তি ওড়িশার বলাঙ্গিরের রাজকন্যা। লক্ষ্যরাজও তাঁদের পারিবারিক হোটেল ব্যবসার হাল ধরেছেন। জগমন্দির দ্বীপ-প্রাসাদকে তিনি সাজিয়েছেন। এখন বিশ্বের ডেস্টিনেশন ওয়েডিং তালিকায় প্রথম দিকে আছে এই প্রাসাদ।
অবশ্য মেবারের রাজপরিবারের বাসভবন উদয়পুর সিটি প্যালেস-ও বিশ্বের সেরা প্রাসাদের তালিকায় অন্যতম। পিছোলা হ্রদের পূর্ব তীরে এই প্রাসাদ তৈরি হতে শুরু করেছিল ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে, মহারানা দ্বিতীয় উদয় সিংহের আমলে। সিসৌদিয়া রাজপুত বংশের এই শাসক মেবারের রাজধানী চিত্তোর থেকে সরিয়ে এনেছিলেন উদয়পুরে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু ঘাত প্রতিঘাত দেখেছে এই প্রাসাদ। মরাঠা শক্তির উত্থানের সময় ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ উদয়পুর তথা মেবার দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। পরে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে মহরানা ভীম সিংহ ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি করে। অন্য শক্তির আক্রমণে মেবার-কে সাহায্য করতে সম্মত হয় ব্রিটিশ শক্তি।
রাজপুত এবং মুঘল স্থাপত্যরীতিতে গ্রানাইট এবং মার্বেল পাথরে এই প্রাসাদ তৈরির সাক্ষী ছিল রাজপরিবারের ২২ টি প্রজন্ম। কাচ, মার্বেল, ম্যুরাল, তৈলচিত্র এবং রুপোর কারুকাজে সম্পূর্ণ হয়েছে প্রাসাদের অন্দরসজ্জা। উদয়পুর প্যালেস কিন্তু একটিমাত্র প্রাসাদ নয়। বরং, এর ভিতরে আছে মোট ১১টি প্রাসাদ।
অমর বিলাস, বড়ি মহল, ভীম বিলাস, চিনি চিত্রশালা, ছোটি চিত্রশালি, দিলখুশা মহল, দরবার হল, ফতেপ্রকাশ প্রাসাদ, কৃষ্ণ বিলাস, লক্ষ্মী বিলাস চক, মানক মহল, মোর চক, রং ভবন এবং শীশ ভবন এই প্রাচীন প্রাসাদের অন্যতম আকর্ষণ। হলিউড-বলিউডের কিছু ছবির শ্যুটিংও হয়েছে এই প্রাসাদে
১৯৭৪ সালে এই প্রাসাদের জেনানা মহলের কিছু অংশ রূপান্তরিত হয় সংগ্রহশালায়। পর্যটক তথা দর্শকরা সেখানে স্বাদগ্রহণ করতে পারেন রাজপুত ইতিহাসের।
বিগত কয়েক বছরে বিপুল সম্পত্তি এবং তার উত্তরাধিকার নিয়ে মাঝে মাঝেই বিবাদ ও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে মেবার রাজবংশে। প্রসঙ্গত, অরবিন্দ সিংহের পাশাপাশি মেবার রাজবংশের যোগ্য উত্তরাধিকারীর দাবিদার তাঁর দাদা, মহেন্দ্র সিংহও। সম্পত্তি নিয়ে লড়াই পৌঁছে গিয়েছে আদালতের দরবারেও।
তবে পারিবারিক বিবাদ সরিয়ে রেখে এখনও ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে উজ্জ্বল মেবার রাজবংশ তথা উদয়পুরের নাম।