মহাকাশ থেকে উড়ে আসা চিনা রকেটের অংশ হাতে এক স্থানীয় বাসিন্দা। (ডান দিকে) মাটিতে পড়ে রয়েছে ওই রকেটের আরও কিছু অবশিষ্টাংশ। মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুরে। পিটিআই
মহাজাগতিক অগ্নিগোলক নয়, নিতান্তই ইহজাগতিক— আরও নির্দিষ্ট করে বললে চৈনিক রকেটের অবশেষ মাত্র। ভারতের আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার পথে শনিবার আগুনের গোলার মতো সেই রকেটখণ্ডই দেখেছিলেন বিমানচালকেরা। পশ্চিম ভারতের আকাশে খালি চোখেও সেই উড়ন্ত অগ্নিপিণ্ড ধরা পড়েছে।
তার পরেই উল্কাবৃষ্টি নিয়ে জল্পনা শুরু হয়।
রবিবার মহাকাশবিজ্ঞানীরা ভ্রম নিরসন করে জানান, শনিবার রাতে কোনও উল্কাবৃষ্টি হয়নি। ২০২১ সালে উৎক্ষেপিত একটি চিনা রকেটের কিছু খণ্ডাংশ ফের পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়ায় ওই ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করে টুইটও করেছেন আমেরিকার মহাকাশবিজ্ঞানী জোনাথন ম্যাকডাওয়েল।
পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রফিজ়িক্স-এর অধিকর্তা তথা পদার্থবিদ সোমক রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, উল্কাবৃষ্টি আচমকা হয় না। বছরের কোন সময়ে উল্কাবৃষ্টি হবে, নির্দিষ্ট গাণিতিক পদ্ধতির মাধ্যমে তা বলে দেওয়া যায়। তা ছাড়া, চিনা রকেটের খণ্ডাংশ যে বায়ুমণ্ডলে ঢুকতে পারে, তারও এক রকমের পূর্বাভাস ছিল। মোটামুটি সেই পূর্বঘোষিত পথ ধরেই এসেছে ওই সব রকেটখণ্ড। তবে তিনি মনে করেন, রকেটের জ্বলন্ত অংশগুলি যে-উচ্চতায় ছিল, তাতে আকাশে বিমানের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল না। কারণ, বিমান তার তুলনায় কম উচ্চতায় ওড়ে।
উল্কা আসলে মহাকাশে থাকা বরফের গ্যাসীয় পিণ্ড। তার ভিতরে প্রচুর ধূলিকণা থাকে। সূর্যের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাপে সেই বরফ গলে গেলে ধূলিকণাগুলি সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবী সূর্যের চার পাশে পাক খেতে খেতে ওই ধূলিকণার মধ্য দিয়ে গেলে সেগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়ে এবং বায়ুর সঙ্গে প্রবল ঘর্ষণে জ্বলে যায়। জ্বলন্ত ধূলিকণার সেই বর্ষণকেই বলা হয় উল্কাবৃষ্টি। ‘‘সেই কারণেই বছরের কোন সময়ে কোন দিক থেকে উল্কাবৃষ্টি হবে, তা বলে দেওয়া সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, ভিডিয়োয় ধরা পড়েছে যে, ওই দিন তিন-চারটি খণ্ড ছিল। উল্কাবৃষ্টি হলে কখনও এত কম সময় ধরে হয় না,’’ বলছেন, সোমকবাবু।
চিনা রকেটের খণ্ডাংশ যে-ভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়েছে, সেটাও বিরল কিছু নয়। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। সোমকবাবু জানান, রকেটের অংশ, বাতিল হওয়া কৃত্রিম উপগ্রহ বা তার অবশেষ মহাকাশে ভেসে বেড়ায়। সেগুলিকে ‘স্পেস ডেবরি’ বা ধ্বংসাবশেষও বলা যায়। সেগুলি পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের চৌহদ্দির বাইরে থাকলেও কখনও কখনও ধাক্কা লেগে উচ্চতা বদল করলে পৃথিবীর অভিকর্ষ টানের ফলে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। প্রবল গতিবেগে বায়ুমণ্ডলে ঢোকার ফলে বায়ুর সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে সেগুলিতে আগুন ধরে যায়। ছোট টুকরো হলে তা আকাশেই ছাই হয়ে যেতে পারে। বড় টুকরো জ্বলতে জ্বলতে মাটিতে এসে পড়তে পারে।
মহাকাশে এই ধরনের ৫০-৬০ হাজার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। সেগুলির গতিবিধির উপরে নিয়মিত নজরদারি চালানো হয়। কোনও মহাকাশযান বা কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের সময় যাতে ওই ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে কোনও ভাবে তার ধাক্কা না-লাগে, বিশেষ ভাবে সতর্ক থাকতে হয় সেই ব্যাপারেও।
শনিবার রাতে ওই রকেটের অংশ মাটিতে এসে পড়েছে বলে খবর। তবে কোনও বড় মাপের ক্ষয়ক্ষতির খবর নেই। সংবাদ সংস্থা
জানিয়েছে, মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর জেলার দু’টি গ্রামে একটি ধাতব বলয় এবং সিলিন্ডারের মতো একটি ধাতব বস্তু পাওয়া গিয়েছে। প্রশাসন সেগুলি বাজেয়াপ্ত করে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছে। ওই সব বস্তু আকাশ থেকেই পড়েছে বলে গ্রামবাসীরা প্রশাসনকে জানিয়েছেন।
চিনা রকেটের অংশ বায়ুমণ্ডলে ঢুকলে তা কোন দিকে যাবে, তার একটি সম্ভাব্য পথ জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সেই পথ অনুযায়ী ওই ধ্বংসাবশেষের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার কথা। তবে সোমকবাবু জানান, ওই ধ্বংসাবশেষ কোন সময়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকবে, সেটা বলা হয় তার ছ’ঘণ্টার হেরফের ধরে। সেই অনুযায়ী সম্ভাব্য পথ বলা হয়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে কোন সময়ে ঢুকছে এবং সেই সময়ের নানা বিষয়ের উপরে নির্ভর করে চূড়ান্ত পথ। তাই এ ক্ষেত্রে মোটামুটি সম্ভাব্য পথে এগোলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছনোর আগেই হয়তো ওই রকেটের খণ্ডাংশ পুরোপুরি জ্বলে ভারতের মাটিতে পড়েছে।