নাতারপুর হাটে। নিজস্ব চিত্র
রাই, সর্ষে, বাজরা, ভুট্টার ঐশ্বর্য ছড়িয়ে রয়েছে দিগন্ত পর্যন্ত একের পর এক। শীতের রোদ চৌকো ক্ষেতের উপর আলোর আলপনা সেরে ছায়ার দিকে। গ্রামের রাস্তায় ঢল গেরুয়া সাইকেলের। যাতে চড়ে মেয়েরা ফিরছে স্থানীয় স্কুল থেকে। সেই গৈরিক-বাহনে লেখা ‘শালা (পাঠশালা) প্রবেশ উৎসব-২২’।
পঞ্চমহলের এই ‘মোরবী হরফ’ জেলায় ভিল, তাড়বি, ভাঙ্গি, বসবা — বিভিন্ন জনজাতির প্রাচীন বসতি। এখানে এবং জনজাতি অধ্যুষিত অন্য এলাকাতেও কোনও স্থানীয় নেতা, বিধায়ক, সাংসদ বা মন্ত্রীর উপর নির্ভর করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, যিনি এই রাজ্যে ভোটের একমেবাদ্বিতীয়ম পোস্টার বয়! মাস কয়েক আগে রাজ্যের জনজাতিদের নিয়ে মেলা করেছেন। জেলা শাসকের যা করার কথা, সেটাই ভোটের আগে করেছেন স্বয়ং মোদী। মেলা করে প্রাইমারি স্কুলে পড়া মেয়েদের জন্য পরিবার পিছু একটি করে সাইকেল দিয়েছেন।
পাঁচ বছর আগে ভোটের সময় এই এলাকায় এসে দেখেছিলাম কংগ্রেসের নিশান উড়তে। জনজাতির মন জিততে আজ নিঃসন্দেহে এগিয়ে না হোক, টক্করে রয়েছেন মোদী। বিধানসভায় জনজাতির জন্য সংরক্ষিত ২৭টি আসনের মধ্যে গত ভোটে কংগ্রেস জিতেছিল ১৫টি আসন। বিজেপি-র জোটে ন’টি। কিন্তু এ বারে ফল ঘুরে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কংগ্রেসের ১১ বারের বিধায়ক জনজাতি নেতা মোহনসিন রাথওয়া বিজেপি-তে চলে গিয়ে গোটা সম্প্রদায়কে বার্তা দিয়েছেন বলেই শুধু নয়। জনজাতিদের ক্ষত গভীর বুঝে, এবং দ্রুত তার আরোগ্য সম্ভব নয় জেনে, ক্ষতের মুখে প্রলেপ দেওয়ার কাজ যতটা সশব্দে করা যায়, বেশ কিছু আগে থেকেই তার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন মোদী-শাহ। মোদী গুজরাতের প্রথম জনসভা করেছেন জনজাতি এলাকায়, বলেছেন, তাঁর কাছে বর্ণমালার প্রথমটি (এ) হল আদিবাসী! দ্রৌপদী মুর্মু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বিজেপি এই পঞ্চমহল, দাহোদ, তাপি এলাকায় গিয়ে মিছিলের পর মিছিল করেছে উৎসবের। জনজাতির বিঘার পর বিঘা জমি দখল করে সেখানে সরকারি প্রকল্পের ঝান্ডা লাগানো থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ও কর্মসংস্থানের অভাবের মতো বিস্তৃত অসন্তোষের মুখে খয়রাতির রাজনীতির মহাকৌশল তো রয়েছেই। গেরুয়া সাইকেল সেই মহাকৌশলের অংশমাত্র।
পঞ্চমহল লোকসভা নির্বাচনী ক্ষেত্রের (গোধরা থেকে ৩৫ কিলোমিটার) মোরবী হরফ জেলার হাটের নাম নাতারপুর। উঁচুনিচু জমিতে প্রায় এক ইডেন গার্ডেন সমান সেই প্রকাণ্ড বাজার। ঊনকোটি রকমের হাতে পেষাই নানা রংয়ের মশলার ছোট-বড় টিলা সাজিয়ে বসে রমণীরা। ভোট নিয়ে প্রশ্ন করলে হেসে গড়িয়ে পড়েন! তাঁদের কারও সামনে বিচিত্র দর্শন ওলের সম্ভার। সেই বুনো ওলের অজস্র মুখ, আয়তনে পেল্লাই, বাঘা তেঁতুল ছাড়া জব্দ করা যাবে না।
কংগ্রেস বা আপ কেউই যে সেই বাঘা তেঁতুল হয়ে উঠতে পারবে না, আসন্ন ভোট বাজারে অন্তত মোরবী হরফে ওই গড়িয়ে পড়া হাসি থেকেই তা স্পষ্ট। এক গুজরাতি-হিন্দি দোভাষীকে জুটিয়ে ওই আনাজের মালকিন কুসুম বেনের সঙ্গে যে কথোপকথন হল, তা মোটামুটি এই রকম: “ভোট তো আসছে। কাকেছাপ দেবেন?”
“সরপঞ্চ যাকে বলবে তাকেই দেব। আগের বার হাতকে দিতে বলেছে, তাই দিয়েছি। এ বার তো কমলই। কোভিডের সময় আর এখনও তো বাড়িতে আনাজ আসছে। আমাদের তো কোনও পয়সা দিতে হয় না।”
খয়রাতির রাজনীতি পুরোদমে তো রয়েছেই। সেইসঙ্গে জনজাতি বলয়ের যে সব গ্রামে ভূগর্ভস্থ জলের সমস্যা, সে সব গ্রামে অগ্রাধিকার দিয়ে ভোটের আগে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা, মোবাইলের সংযোগ জোরদার করা, স্থানীয় জনজাতির কোনও অতীত নেতাকে বেছে নিয়ে তাঁর মূর্তি করে কীর্তি প্রচারের মতো বিষয়গুলি রয়েছে। এই সম্প্রদায়ের চার জন বিধায়ককে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয়েছে, সেটাও কম কথা নয়।
ঘরোয়া ভাবে আরও একটা কথা বলছেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতা কর্মীরা। এই এলাকার জনজাতির মনে নেহরু-গান্ধী পরিবারের জন্য আজও দুর্বল জায়গা রয়েছে। গত বারের ভোটে জনজাতিপ্রধান এলাকার মধ্যে দিয়ে রাহুলের যাত্রা এবং অল্পবয়সিদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানোয় বিলক্ষণ লাভ পেয়েছিল কংগ্রেস। কিন্তু এ বারে রাহুল বা প্রিয়ঙ্কাকে সে ভাবেই দেখতেই পায়নি এই গ্রামগুলি।
তফসিলি জনজাতির সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা মনসুখ ভাসাভা স্পষ্টই বললেন, “এটা ঠিকই যে এই সম্প্রদায়ের মানুষ কিছু কিছু কারণে আমাদের দলের উপর রুষ্ট। কিন্তু আমরা প্রাণপণে তাঁদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছি। সরপঞ্চ, তালুক পঞ্চায়েত এবং জেলা পঞ্চায়েত স্তরে আমরা ঢুকে গিয়েছি। এই সব আসন আমাদের দখলে। ফলে বিধানসভা ভোটে তার প্রভাব তো পড়বেই।”