বিচ্ছেদ উৎসবের আমন্ত্রণপত্র।
কচি সংসদের কেষ্টর ঢঙে বলতে চাইলে বলতে হয়— বিবাহ একটা ভূমিকম্প, ঝঞ্ঝাবাত, নায়াগ্রা-প্রপাত, আকস্মিক বিপদ যাতে বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়। অন্তত ভোপালের যে ১৮ জন নিজেদের বিবাহ বিচ্ছেদের উদ্যাপন করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা হয়তো এখন এমনই ভাবেন।
মঙ্গলবার সকালে সমাজমাধ্যমে ভাইরাল লাল টুকটুকে একটি কার্ড। উপরে বড় হরফে লেখা, ‘ডিভোর্সের আমন্ত্রণ’। নীচে অনুষ্ঠান সূচিতে ‘জয়মালা বিসর্জন’, ‘বারাত নির্গমন’, ‘সদবুদ্ধি শুদ্ধিকরণ যজ্ঞ’, ‘জেন্টস সঙ্গীত’, সাত পাকে ঘুরে নিজের সম্মান রক্ষার্থে সাতটি প্রতিজ্ঞা ও প্রধান অতিথির হাতে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি তুলে দেওয়া। সদ্যই শেষ হয়েছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ১৮ জন সদস্যের দীর্ঘ ও তিক্ত বিচ্ছেদ মামলা। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর ভোপালের বিলখিরিয়ার একটি রিসর্টে ‘বিবাহ বিচ্ছেদ সমারোহ’ অনুষ্ঠান করে তার উদ্যাপন করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। বাদ সাধল একটি দক্ষিণপন্থী সংগঠন। এমন অনুষ্ঠান ‘ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী’ বলে প্রতিবাদ উঠতেই সব আয়োজন বাতিল করে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। তাদের সভাপতি জ়াকি আহমেদ জানিয়েছেন, তাঁদের সংগঠন বিপদে-আপদে পুরুষদের পাশে দাঁড়ায়। তাঁরা বিতর্ক চান না। অনুষ্ঠানটি ব্যক্তিগত ছিল, ২০০ জন ছিলেন নিমন্ত্রিত।
সমাজতত্ত্ববিদ রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ভারতের মতো দেশে বিচ্ছেদ একটি তিক্ত প্রক্রিয়া। অনেকের ক্ষেত্রে তা এত বেশি তিক্ত হয়ে ওঠে যে, তখন তাঁরা মনে করেন উদ্যাপন প্রয়োজন। এই ১৮ জনের ক্ষেত্রে হয়তো বিষয়টি সে রকমই। তাঁরা অভিনব ভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এটিকে সমাজের স্বাভাবিক ধারা বলা যায় না।
‘ডিভোর্সের আমন্ত্রণের’ কার্ড ভাইরাল হতেই প্রতিবাদে-সমর্থনে সমাজমাধ্যম সরগরম। হ্যাশট্যাগ-সহ ছড়িয়ে পড়ে ‘বয়কটম্যারেজ’ ও ‘ম্যারেজস্ট্রাইক’ স্লোগান। পুরুষদের অনেকের দাবি, আদালত মেয়েদের সমস্ত আইনি সুবিধা দিয়ে রেখেছে। বিয়ে সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে মেয়েদের দাবিই মানা হয়, সে বিচ্ছেদ হোক বা খোরপোশ। আদতে পুরুষেরাই যে অত্যাচারিত ও প্রতারিত, তা সমাজের চোখে পড়ে না। প্রত্যুত্তরে মেয়েরা বলেছেন, এমন মানসিকতার পুরুষেরা যদি বিয়ে করতে না চান, তাতে আখেরে মেয়েদেরই মঙ্গল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রামের মতে, যে কোনও সম্পর্কেই তিক্ততা আসতে পারে, সেখান থেকে বিচ্ছেদও হয়। কিন্তু ডিভোর্সকে উদ্যাপন করে জীবনে আর বিয়ে না করার ঘোষণা আদতে অপরিণত মনের পরিচায়ক।
এই চর্চায় উঠে এসেছে বৈবাহিক ধর্ষণের কথাও। বৈবাহিক সম্পর্কে বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক ধর্ষণ কি না, তা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘ দিনের। গত মে মাসে বৈবাহিক ধর্ষণ সংক্রান্ত একটি আবেদনের শুনানিতে দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি রাজীব শকধর বলেছিলেন, স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্কের জন্য স্বামীকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা যেতেই পারে। একমত হননি বেঞ্চের অন্য বিচারপতি সি হরি শঙ্কর। সেই প্রেক্ষিতেই সমাজমাধ্যমে দাবি উঠেছে, বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ বলা আসলে পুরুষদের হেনস্থা করারই একটি চাল। রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, পুরুষেরা বেশি অত্যাচারিত— এই দাবি যাঁরা করেন, তাঁরা ব্যক্তিগত পরিসর থেকে করেন। এই দাবি সম্পূর্ণ অমূলক। ক্ষমতার অপব্যবহার এখনও পুরুষেরাই বেশি করেন। তবে মেয়েদের প্রতি তাঁর বার্তা, সার্বিক ভাবে শ্রেণিসচেতনতা না এলে যে কোনও ভারসাম্য রক্ষা এখনও বেশ কঠিন।