ফাইল ছবি
বায়ুদূষণের জেরে ভারতীয়দের প্রত্যাশিত আয়ু কমতে পারে প্রায় পাঁচ বছর। এমনটাই দাবি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের (একিউএলআই) নবতম রিপোর্টে। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের সবচেয়ে দূষিত শহর দিল্লি। দূষণের জেরে সেখানে আয়ু কমতে পারে ১০.১ বছর। অন্য দিকে, বিশ্বে বায়ুদূষণের জেরে ৯৭.৩ শতাংশ নাগরিকের জীবনই ঝুঁকির মুখে।
২০২০ সালের তথ্যের উপর ভিত্তি করে ওই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভারতীয়দের ৬৩ শতাংশই এমন অঞ্চলে বাস করেন, যেখানে বায়ুদূষণ জাতীয় মানের (প্রতি ঘনমিটারে ৪০ মাইক্রোগ্রাম) উপরে। ওই রিপোর্ট অনুসারে বিশ্বের বায়ুদূষিত দেশগুলির তালিকায় বাংলাদেশের (৭৫.৮ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার, নাগরিকদের আয়ু কমতে পারে ৬.৯ বছর) পরেই রয়েছে ভারত। দেশে বায়ুদূষণের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে সপ্তম স্থানে। এ রাজ্যে দূষণের পরিমাণ ৬৫.৪ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার। তার ফলে রাজ্যবাসীর আয়ু কমতে পারে ৫.৯ বছর।
রিপোর্ট বলছে, বিশ্বে বায়ুদূষণের জেরে মানুষের আয়ু কমতে পারে ২.২ বছর। অন্য দিকে ধূমপানে ১.৯ বছর, মদ্যপানে আট মাস, অসুরক্ষিত জলের মাধ্যমে সাত মাস, এইচআইভি ৪ মাস, ম্যালেরিয়া ৩ মাস এবং সন্ত্রাসের জেরে আয়ু কমতে পারে ৯ দিন।
আজ প্রকাশিত ওই সূচকে বলা হয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বে দূষণবৃদ্ধির হারের ৪৪ শতাংশের জন্যই দায়ী ভারত। ২০১৩ সালে যেখানে প্রতি ঘনমিটারে ৫৩ মাইক্রোগ্রাম দূষণ ছিল, সেটাই বর্তমানে বেড়ে হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ৫৫.৭ মাইক্রোগ্রাম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র বেঁধে দেওয়া সীমার (প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে যা ১১ গুণ বেশি! গত বছর দূষণ বিধির ক্ষেত্রে পরিবর্তন করেছিল হু। আগে বছরে প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম দূষণ সহনশীল হিসাবে বিবেচিত হত। তা কমিয়ে করা হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম।
দূষণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দেশে ২০১৯ সালে ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম (এনসিএপি)-এর সূচনা করা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি তো হয়ইনি, উল্টে অবনতি হয়েছে। দূষণ সূচকে দেখা যাচ্ছে, ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমিতে হু-র নির্ধারিত দূষণ স্তর অপেক্ষা দূষণের মাত্রা সর্বোচ্চ বেড়েছে ২১গুণ (দিল্লি এনসিটি অঞ্চলে ১০৭.৬ মাইক্রোগ্রাম/ঘনমিটার)। গত দু’দশকে এই অঞ্চলের দূষণ পরিস্থিতি সব চেয়ে খারাপ হয়েছে। অবস্থা গুরুতর দিল্লি, বিহার এবং উত্তরপ্রদেশেও। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে ২০০০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত দূষণ বেড়েছে যথাক্রমে ৬৮.৪% এবং ৭৭.২%। দেশে সব চেয়ে কম দূষণ লাদাখে। এর পরে রয়েছে যথাক্রমে অরুণাচল প্রদেশ, কেরল, আন্দামান নিকোবর, পুদুচেরি, তামিলনাড়ু, গোয়া, নাগাল্যান্ড, কর্নাটক। মূলত শিল্পায়ন, আর্থিক উন্নয়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে দূষণবৃদ্ধির কারণ হিসাবে দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া, রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলা তো রয়েছেই। গঙ্গার দু’পাশে প্রচুর শহরাঞ্চল রয়েছে। সেখানে কারখানা ও চাষের জমিও অনেক বেশি। ফলে সেখান থেকে ধুলো-ধোয়াঁ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। এর পাশাপাশি পঞ্জাব-হরিয়ানায় নাড়াপোড়ার জেরে প্রতি বছর শীতকালে ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে যায় রাজধানী।
ভূগোলের অধ্যাপক এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি মানবসম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্রের অধিকর্তা লক্ষ্মীনারায়ণ সৎপতি বলেন, ‘‘বিশ্বায়নের পরে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধি বিপুল। শিল্প, কৃষি কিংবা জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলে তার প্রভাব দেখা যাবে জনজীবনেও। তার একটা অংশ উন্নয়ন আর একটা বর্জ্য। এর ফলে দূষণ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিও আছে। ভারতকে বিশ্বের অন্যতম দূষিত দেশ হিসাবে দেখাতে পারলে এখানকার অগ্রগতি নিয়েও প্রশ্ন তোলা যাবে।’’
গত বছর ল্যানসেটের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, দূষণের জেরে ২০১৯ সালে মৃত্যু হয়েছিল ২৩ লক্ষ ভারতীয়ের। তার মধ্যে শুধু বায়ুদূষণের বলি ১৬ লক্ষ! জল দূষণের শিকার ৫ লক্ষ নাগরিক। দূষণ নিয়ে বরাবর সরব পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সুভাষ দত্ত। তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশে বিদ্যুৎ আসে কয়লা পুড়িয়ে। সেখানে রাতে কেন ক্রিকেট খেলা হবে? এই নিয়ে মামলাও করেছিলাম। আমরা আসলে আত্মহত্যা করছি। তাৎক্ষণিক স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম ডেকে আনছে বিপর্যয়। উন্নয়ন মানে কিন্তু ধ্বংস নয়।’’ কলকাতার দূষণ সম্পর্কে সুভাষ বলেন, ‘‘এ শহর ঘিরে রেখেছে কতগুলো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এখানে বিদ্যুৎ ব্যবহারের নামে অপচয় হচ্ছে। ত্রিফলা জ্বালিয়েও বিদ্যুৎ নষ্ট হচ্ছে।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।