S. Jaishankar

কুলোর বাতাস

হিন্দু জাতীয়তাবাদ কখনও সমাজতন্ত্রকে সোজা চোখে দেখেনি। জয়শঙ্করের বক্তব্য থেকে যদি ধরে নেওয়া যায় যে, ‘নেহরু মডেল’ বলতে তাঁরা এখনও মূলত সমাজতান্ত্রিক ভাবনাকেই বোঝেন, তা হলে বলতে হবে, নেহরুর আদর্শকে তাঁরা ততটা বুঝতে পারেননি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৪:৩১
Share:

বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, তাঁরা ‘নেহরু মডেল’ সংস্কারের কাজ সমাধা করছেন। অর্থাৎ, জওহরলাল নেহরুর যে উত্তরাধিকারগুলি ভারতে ছিল, সেগুলিকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদায় করার কাজ সম্পন্নপ্রায়। রাষ্ট্রচালনার প্রক্রিয়ার দিক দিয়ে যোজনা কমিশনকে বিদায় করে নীতি আয়োগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, আবার রাষ্ট্রের ভিত হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে যমুনার কালো জলে ফেলে দিয়ে সংখ্যাগুরুবাদ দেশের দখল নিয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে এক গভীর সংযোগ আছে, যা জয়শঙ্করের বক্তব্যটিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এবং এই কারণেই মোদী শাসনের লাগাতার নেহরু-নিন্দার মধ্যেও বিদেশমন্ত্রী মহাশয়ের এই কথাটির একটি আলাদা তাৎপর্য আছে। তাঁর বক্তব্য, রাশিয়া এবং চিনের যে অর্থনৈতিক ভাবাদর্শে নেহরু যুগের ভারত উদ্বুদ্ধ ছিল, সে দেশ দু’টি বহু কাল আগেই সেই আদর্শ থেকে সরে গিয়েছে; কিন্তু ভারতে কিছু মানুষ এখনও সেই আদর্শকে আপ্রাণ আঁকড়ে থাকতে চান। জয়শঙ্কর বুঝিয়ে দিয়েছেন, এখানেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাঁর সরকারের আদর্শের যোগ। ঠিক এই সংযোগটি প্রতিষ্ঠা করতেই, বর্তমান সরকার সংবিধানের মুখবন্ধ থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ কথাটি বাদ দিতে দীর্ঘ দিন ধরেই এত সক্রিয়, যদিও শীর্ষ আদালতের আপত্তিতে কাজটি আপাতত আটকে গেল।

Advertisement

হিন্দু জাতীয়তাবাদ কখনও সমাজতন্ত্রকে সোজা চোখে দেখেনি। জয়শঙ্করের বক্তব্য থেকে যদি ধরে নেওয়া যায় যে, ‘নেহরু মডেল’ বলতে তাঁরা এখনও মূলত সমাজতান্ত্রিক ভাবনাকেই বোঝেন, তা হলে বলতে হবে, নেহরুর আদর্শকে তাঁরা ততটা বুঝতে পারেননি। তা অবশ্য আশ্চর্যের কথা নয়— গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা আর কবেই বা নেহরুর সর্বজনীন উদারবাদী অবস্থানের মাহাত্ম্য বুঝেছেন। ভারতীয় রাজনৈতিক অর্থনীতির ছাত্ররা মনে করিয়ে দেবেন, ১৯৫৫ সাল অবধি কংগ্রেসে ঘোষিত ‘সোশ্যালিস্টিক প্যাটার্ন অব সোসাইটি’-র আদর্শ, দু’দশক পরে যা ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধে ঠাঁই পেয়েছিল, নেহরুর সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদর্শের এক অতি তরলায়িত রূপ। তাকে সমাজতন্ত্র বলে মানতে বামপন্থী রাজনীতির ঘোর আপত্তি ছিল; এমনকি নেহরুও একে আগমার্কা সমাজতন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করতে চাননি। এবং, সেই না-চাওয়ার কারণটির মধ্যেই নিহিত ‘নেহরু মডেল’-এর প্রকৃত সত্য— তাঁর কাছে সমাজতন্ত্র ছিল একটি অস্ত্র, যার মাধ্যমে দেশে সর্বজনীন উন্নয়নভিত্তিক একটি জাতীয়তার ধারণা তৈরি করা যায়। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ এবং সেই খণ্ডিত দেশেও ভাষা ও আঞ্চলিক পরিচিতির ভিত্তিতে ক্রমবর্ধমান খণ্ড-জাতীয়তাবাদী দাবির স্রোতের মুখে বাঁধ দিতে যে নতুন জাতীয়তার সংজ্ঞা প্রয়োজন, নেহরু তা উপলব্ধি করেছিলেন। সেই জাতীয়তাবাদে পৌঁছনো ছিল ‘নেহরু মডেল’-এর লক্ষ্য— এমন এক দেশ প্রতিষ্ঠা, যেখানে ভারতীয়ত্বের ঊর্ধ্বে আর কোনও পরিচিতির ঠাঁই নেই।

অর্থাৎ, শতবর্ষী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা তৎকালীন হিন্দু মহাসভার মতো প্রতিষ্ঠানগুলি যে ভারতের স্বপ্ন দেখত, তার বিপ্রতীপ অবস্থানটির নামই ‘নেহরু মডেল’। নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হলে হিন্দুত্ববাদীরা এই মডেলের গোড়ায় আঘাত করতে চাইবেন, এই কথাটি তাঁদের ক্ষমতাপ্রাপ্তির ঢের আগে থেকেই অতি স্পষ্ট। জয়শঙ্কর যে কথাটি বলে উঠতে পারেননি, তা হল, এই ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন উদার বহুত্ববাদী ভারতকে ধ্বংস করার কাজটি তাঁরা প্রায় সেরেই ফেলেছেন। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ এখন এ দেশের অন্যতম চালিকাশক্তি— এমনকি সেনাপ্রধানের দফতরেও ১৯৭১-এর জয়ের স্মারক ছবির পরিবর্তে এমন ছবি ঝোলানো হয়, যাতে হিন্দুত্ববাদী প্রতীকের উপস্থিতি প্রকট। তবে, তাঁরা সম্ভবত এ কথাও জানেন যে, ভারত নামক ধারণাটির প্রাণশক্তি অবিশ্বাস্য। মরতে মরতেও ফের বেঁচে ওঠার অসীম সম্ভাবনা নিহিত সেই ধারণার বীজে। সম্ভবত সেই কারণেই তাঁরা অদম্য ভঙ্গিতে ‘নেহরু মডেল’-এর উপরে আঘাত করেই চলেছেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement