হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইল ফোনটি এখন এক সম্পূর্ণ দুনিয়া। কোভিড অতিমারির পরে গত কয়েক বছরে সেই দুনিয়ায় জন্ম হয়েছে এক নতুন গোত্রের তারকাকুলের— যাঁদের পোশাকি নাম ইনফ্লুয়েন্সার, ডাকনাম ভ্লগার। সোশ্যাল মিডিয়ায় যদি আপনার একটি অ্যাকাউন্ট থাকে, তা হলে এই ভ্লগারদের আপনি নির্ঘাত চেনেন। তাঁদের একটি অংশ শহরের অলি-গলি-রাজপথ, মফস্সলের রেল স্টেশন থেকে গ্রামের হেঁশেল, সর্বত্র সুখাদ্যের সন্ধান করেন। এবং, একদা যে খাবারের দোকানটি ছিল নিতান্তই স্থানীয় মানুষদের পরিচিত, ‘ফুড ভ্লগার’দের ক্যামেরা বেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় তা-ই হয়ে ওঠে সর্বজনীন। রাতারাতি ভাইরাল হয় স্টেশনে, বাজারে, ঝুপড়ি দোকানে বিরিয়ানি বা পেটাই পরোটা, রাস্তার ধারে সাইকেল ভ্যানের পোলাও-মাংস, বা চা বেচতে বসা দাদা-দিদি-কাকারা। বহু দূর থেকে বয়ে এনে দাঁড়িয়ে ‘রুমালি’ পরোটা বেচা কোনও ভাই। কেউ প্রবাস-প্রত্যাগত হলে সেটাও জড়িয়ে যেতে পারে নামের সঙ্গে। যুক্ত থাকতে পারে গ্র্যাজুয়েট থেকে বি টেক-এর মতো শিক্ষাগত যোগ্যতার কথাও।
আবার এ ভাবে নিজের দোকানের খাবার, রন্ধনপ্রণালী, পরিবেশনার রীতি-রেওয়াজ সব কিছু ক্যামেরায় তুলে ধরতে ধরতে কখনও-কখনও এই বিক্রেতাদের মধ্যে কয়েক জনও হয়ে উঠছেন রীতিমতো তারকা। তাঁরা যেন খোলা হাট-বাজারে খেলা দেখানো জাদুকর। তাঁদের খোলা রন্ধনশালা এক অর্থে গরিবের ‘ওপেন কিচেন’। সেই সমৃদ্ধিহীন পরিসরেও তাঁরা রান্নায় ঢেলে দিচ্ছেন ঘি, মাখন, ভাল ব্র্যান্ডের তেল, অসময়ের আনাজ— মোবাইলের পর্দায় মুগ্ধ হয়ে দেখছি। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন সংলাপ, ক্ষেত্রবিশেষে শরীরী ভঙ্গিও। সেই সূত্রেই চালু হয়ে যায় তাঁদের কারও কারও ফ্যান পেজ।
যে কোনও বাজারের মতোই এই বাজারও নিত্যনতুন পণ্য চায়। খাদ্যপণ্য নয়, দৃশ্যপণ্য— মোবাইলের স্ক্রিনে। মুগ্ধতা জিইয়ে রাখার প্রয়োজনেই তৈরি হয় নিত্যনতুন রিল। শুরু হয় আসল লড়াই, নকল লড়াই, বিবৃতি যুদ্ধ, আদিরসাত্মক অভিব্যক্তি। হারিয়ে যাওয়ার ভয় তাঁদের সবারই— ক’দিন আগে তুমুল বিখ্যাত ‘বাদাম কাকু’-র খোঁজ এখন আর কে-ই বা রাখে!
অনেকেই হাড়ে-চটা ফুড ভ্লগারদের উপরে। শুধু সস্তায় বাজিমাত করার প্রচেষ্টার কারণেই নয়— অভিযোগ যে, তাঁরা বহু ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছেন খেটে খাওয়া মানুষজনের সামনে। শুধু ক্যামেরা হাতে ভিড় করে বিকিকিনিতে সমস্যা তৈরি করা নয়। অন্য কোনও ভ্লগারের অভাবনীয় তারিফে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া কোনও খাদ্য বিক্রেতার ত্রুটিবিচ্যুতি, দোকানের অপরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি নিয়ে ভ্লগ তৈরি করেন কেউ কেউ— তার কতটা সত্য, কতটা কাল্পনিক, সে প্রশ্ন থাকেই। দোকানের ঝামেলা, মেজাজ হারিয়ে বচসা— সব কিছুই ‘ফুড ভ্লগিং’-এর অঙ্গীভূত।
কিন্তু তার পরও এই ভ্লগার এবং বিক্রেতাদের অনেকেই হয়ে ওঠেন সেলেব্রিটি— এতটাই যে, কোনও অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে ডাক পড়ে তাঁদের, কোনও দোকান উদ্বোধন হয় তাঁদের হাতে। পথেঘাটে লোকের হামলে পড়া ভিড় তো আছেই। ইংরেজিতে বললে, এঁরা ‘মাইনর সেলেব্রিটি’। তবে, প্রভাবশালী— নামকরা রেস্তোরাঁর মালিক বা কেটারিং কর্তারাও নামজাদা ফুড ভ্লগারদের দিয়ে সুখ্যাতি প্রচারের আগ্রহী। ক্ষেত্রবিশেষে ভিন্নতর পণ্যের প্রচারেও এদের অংশগ্রহণের উত্তরোত্তর বৃদ্ধিরেখা প্রমাণ করে প্রভাব ক্রমবর্ধমান।
কেন? কারণ এ আসলে ন্যাচারাল লাইট, মোবাইল ক্যামেরা আর স্বতঃস্ফূর্ত অ্যাকশনে তৈরি বৃহৎ পুঁজির পরোয়াহীন এক ধরনের রিয়্যালিটি শো। যেখানে সোপ অপেরার সাজানো সেট, বাহারি অলঙ্কার, সযত্ন শৌখিনতা নেই, কিন্তু জীবনের উত্থান-পতনের গল্প আছে। সেই গল্পে একের সুখে-দুঃখে অন্যের পাশে দাঁড়ানো আছে। ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা ও বৈরর ছাইচাপা অথবা হাঁ-মুখ আঁচের উত্তেজনা আছে। কঠিন সংগ্রাম, স্বপ্নপূরণ, স্বপ্নকে ধাওয়া করার টানটান উপাখ্যান আছে। ক্ষেত্রবিশেষে পোশাকে-আশাকে, বানানো রিলে ঈষৎ যৌনগন্ধী প্রতিবেশ আছে। এদের কেউ যেমন ক্যামেরার সামনে দুঃখীজনে বিলিয়ে দেন সাধ্যমতো ত্রাণ, কেউ অর্থ সংগ্রহের আহ্বান বা উদ্যোগ নিয়ে হয়ে উঠতে চান রোগগ্রস্ত অপর জনের ত্রাতা। দর্শককে চমকিত করতে পারার মতো বাজার-গরম সংলাপ, ভাল ব্যবহার-খারাপ ব্যবহারের পাশাপাশি পারস্পরিক আত্মীয়তা, বাবা-মেয়ে, মা-ছেলে, পিঠোপিঠি দুই বোনের জীবন সংগ্রামের কঠোর লড়াইয়ের আখ্যান আর সবটা মিলিয়ে এক দল ভাগ্য-বিড়ম্বিত মানুষের জয়ের খণ্ডকাব্য।
নব রসের প্রায় প্রত্যেকটির উপস্থিতি সৌজন্যেই সোপ অপেরা, রিয়্যালিটি শো-এর এক রকম বিকল্প হয়ে উঠতে পেরেছে বঙ্গীয় ফুড ভ্লগিংয়ের পরিসরটি। মোবাইল ফোনের পর্দায় বিরক্তিকর দ্বিপ্রহরে, ক্লান্তিময় সায়াহ্নে, বিনিদ্র মধ্যরাতে অসংখ্য অবাক দৃষ্টি জোড়া জোড়া চোখ দেখছে— কোনও বিক্রেতা বা ভ্লগারের সাইকেল কেমন পাল্টে যাচ্ছে চার চাকা শকটে, সাদা সিমেন্টের মেঝে দৃষ্টিনন্দন সেরামিক টাইলস-এ, ফুটপাতের দোকান জিএসটি দেওয়া প্রতিষ্ঠানে। হাটে-বাজারে, হোটেলে-শোরুমে তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে, হাত মেলাতে এগিয়ে আসছে মানুষ। তারা খেতে ঢুকলে, কিনতে ঢুকলে মিলছে সৌজন্যমূলক স্বীকৃতি। স্বপ্নপূরণের গল্প দেখতে কার না ভাল লাগে!
বাংলা বিভাগ, শ্রীগোপাল ব্যানার্জী কলেজ