কিছু কিছু ঘটনা ঘটে চোখের সামনে। অধিকাংশই ঘটে আড়ালে, জনদৃষ্টির অন্তরালে। গত কয়েক বছরে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যে ভাবে ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি করেছে চিন, তার প্রভাব হতে চলেছে সুদূরপ্রসারী। আগামী দিনে সমুদ্রশক্তির নিরিখে তারা আমেরিকাকেও সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাবে। এ-হেন পরিস্থিতিতে ভূরাজনৈতিক স্বার্থরক্ষা এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধির প্রয়োজনে নিজের নৌশক্তি আরও ধারালো করতে চাইছে ভারত। সম্প্রতি রুশ বন্দর শহর কালিনিনগ্রাদে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের উপস্থিতিতে ভারতীয় নৌসেনায় আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তি হল আইএনএস তুশিল-এর। উন্নত ক্রিভাক থ্রি ক্লাস-এর রণতরী তুশিল ‘প্রোজেক্ট ১১৩৫.৬’-এর অংশ, যার ছ’টি জাহাজ ইতিমধ্যেই ভারতীয় নৌসেনায় পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে। রুশ সহযোগিতায় নির্মিত অত্যাধুনিক এই রণতরীকে শুধু দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সুফলই নয়, মোদী সরকারের ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের এক অগ্রণী উদাহরণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম এই তরীর অনেক যন্ত্রাংশই ভারতে নির্মিত। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে দু’দেশের মধ্যে চারটি ‘স্টিলথ ফ্রিগেট’ নির্মাণের চুক্তি হয়, যার মধ্যে দু’টি তৈরি হওয়ার কথা রাশিয়ায়। এরই প্রথমটি আইএনএস তুশিল।
তুলনামূলক ভাবে স্বল্প খরচ হওয়ার কারণে এবং জটিল প্রযুক্তি ভাগ করে নেওয়ায় আজ বহু বছর যাবৎ দিল্লির অন্যতম অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে রাশিয়া। তবে বিবিধ কারণে সাম্প্রতিক কালে এ ক্ষেত্রে দিল্লির মস্কো-নির্ভরতা খানিক হ্রাস পেয়েছে। অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র আমদানির পাশে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র মাধ্যমে দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদন শিল্পকে আরও কার্যকর করে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। দিল্লির এই প্রবণতা ইউক্রেন যুদ্ধ-পূর্ববতী হলেও, বর্তমান যুদ্ধপরিস্থিতিতে তা আরও বেড়েছে। যুদ্ধের জেরে দেরি হচ্ছে যুদ্ধবিমানের খুচরো অংশের সরবরাহে। শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘায়িত যুদ্ধ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে রুশ অস্ত্রের কার্যকারিতার উপরেও। অন্য দিকে, মস্কো-বেজিং সখ্য উদ্বেগ বাড়িয়েছে দিল্লির। সম্প্রতি দুই রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যে ভাবে গাঢ় হয়েছে, তাতে এর পর বেজিং-এর সঙ্গে কূটনৈতিক বিবাদে দিল্লি মস্কোকে পাশে পাবে কি না, প্রশ্ন থাকছেই। পাকিস্তানকে চিনের অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টিও তো ভারতকে আগাগোড়াই উদ্বিগ্ন রাখে।
এমতাবস্থায় অস্ত্রভান্ডারের ক্ষমতা বাড়াতে আমেরিকা-সহ ফ্রান্স, জার্মানি, ইজ়রায়েল-মুখী হয়েছে ভারত। আমেরিকান ও ফরাসি ইঞ্জিন দিয়ে ফাইটার জেট কিংবা জার্মান এবং স্প্যানিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডুবোজাহাজের নির্মাণ পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে আমদানি-নির্ভরতা হ্রাস করতে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ এখনও সফল নয়। তা ছাড়া, দেশের সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগ এখনও রুশনির্মিত হওয়ার ফলে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাও অসম্ভব। শুধু তা-ই নয়, পূর্বের ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রের মতো সম্প্রতি বর্ম-ভেদী ম্যাঙ্গো শেল বা কালাশনিকভ এ কে ২০৩ অ্যাসল্ট রাইফেল-এর মতো সামরিক সরঞ্জামের উন্নয়ন এবং নির্মাণ উদ্যোগে এখনও দিল্লির সহযোগী রাশিয়া। ফলত, নতুন ভূরাজনৈতিক পরিবেশে রাশিয়ার সঙ্গে সমীকরণ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে ভারতকে।