সুভাষচন্দ্র বসুকে শ্রদ্ধা নরেন্দ্র মোদীর। রবিবার সংসদ ভবনে। ছবি: পিটিআই।
ইন্ডিয়া গেটের ঠিক পিছনের ছত্রিতে সুভাষচন্দ্র বসুর লেজ়ার রশ্মির মাধ্যমে তৈরি ত্রিমাত্রিক ছবি বা হলোগ্রামের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ কংগ্রেস তথা নেহরু-গান্ধী পরিবারকেই নিশানা করলেন। পাশাপাশি সুভাষচন্দ্রের বর্ণিত ‘রাষ্ট্রবাদ’ হিসেবে নিজের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেই তুলে ধরলেন। যা বললেন তার সার কথা— স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘লাখো লাখো মানুষের’ ভূমিকা ছিল। কিন্তু সেই ইতিহাস চেপে দেওয়া হয়েছে। আজকের সরকার ‘গর্বের সঙ্গে ঢাকঢোল পিটিয়ে’ আগের ভুলগুলিকে সংশোধন করছে।
সুভাষচন্দ্রের ১২৫-তম জন্মদিনে এ ভাবেই তাঁর ‘হলোগ্রাম মূর্তি’-র উদ্বোধন করে ‘স্বাধীনতার নতুন ইতিহাস’ গড়ার দাবি করলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। জানালেন, এই হলোগ্রাম সরিয়ে এখানেই বসানো হবে গ্র্যানাইট পাথরের মূর্তি। রাইসিনা হিলসের উপর থেকে রাজপথের উপর দিয়ে ইন্ডিয়া গেটের দিকে তাকালে সোজাসুজি সুভাষচন্দ্রের মূর্তিই দেখা যাবে। ওই মূর্তি দৈর্ঘ্যে হবে ২৮ ফুট, প্রস্থে ৬ ফুট।
রাজনৈতিক শিবিরের মতে, ক্ষমতায় বসার পর থেকেই সুভাষচন্দ্র সম্পর্কে মোদীর প্রবল উৎসাহের সাক্ষী থেকেছে দেশ ও বাংলা। একটি সূত্রের মতে, সুভাষচন্দ্রকে কাজে লাগিয়ে গান্ধী-নেহরু পরিবারকে বার বার কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগ সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছেন মোদী।
রবিবার সুভাষচন্দ্রের জন্মদিবসের মঞ্চকে ব্যবহার করে তাঁকে নিয়ে সরকারের যাবতীয় উদ্যোগকে তুলে ধরতে দেখা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। আজ দু্র্যোগ মোকাবিলায় নেতাজির নামে পুরস্কার দিয়েছেন তিনি এই মঞ্চ থেকেই। জানিয়েছেন, আজ থেকেই স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব শুরু হল। তার আগেই এই দিনটিকে ‘পরাক্রম দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মোদীর কথায়, “ভারত তার নিজের পরিচয় এবং প্রেরণাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলছে। দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতার পর দেশের সংস্কার এবং সংস্কৃতির সঙ্গে অনেক মহান ব্যক্তিত্বের সংযোগকে মুছে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে লাখো লাখো দেশবাসীর তপস্যা সংযুক্ত ছিল। কিন্তু তাঁদের ইতিহাসকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আজ দেশ তথা সরকার ঢাক পিটিয়ে গর্বের সঙ্গে ওই ভুলের সংশোধন করছে।”
শুধুমাত্র সুভাষচন্দ্রই নন, আজ বাবাসাহেব অম্বেডকর, বল্লভভাই পটেল, বীরসা মুন্ডার মতো নেতাদেরও বিস্মরণ থেকে আলোয় আনার দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। অম্বেডকরের পঞ্চতীর্থ, বল্লভভাই পটেলের নর্মদার ধারে ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’-র জয়গান করেছেন। পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগে রবিবার সন্ধ্যায় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, “ভগবান বিরসা মুন্ডার জন্মদিবসকে জনজাতি দিবস হিসেবে পালন করার প্রথা আমরা শুরু করেছি। স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীদের অবদানকে সামনে আনতে বিভিন্ন রাজ্যে মিউজিয়াম তৈরির কাজ শুরু করেছি।”
২০১৮-তে সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠার ৭৫-তম বর্ষপূর্তিতে লাল কেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন মোদী। লাল কেল্লায় ‘নেতাজি সংগ্রহশালা’-রও উদ্বোধন করেছিলেন। আজ এই ঘটনাগুলিকে ফের স্মরণ করে মোদীর বক্তব্য, এই সবই তাঁর ‘জীবনের অমূল্য স্মৃতি’। গত বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুভাষচন্দ্রের জন্মদিবসে তিনি কলকাতায় যান। বিরোধীরা সে সময় তাঁর এই পদক্ষেপকে ভোটে বঙ্গ আবেগের ঢেউ তোলার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। আজ মোদী বলেন, “আমার সৌভাগ্য, গত বছর এই দিনটিতেই আমি কলকাতায় নেতাজির পৈতৃক নিবাসে যেতে পেরেছিলাম। তিনি যে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন, উনি যে ঘরে পড়তেন, সেই ঘরের দেওয়াল ইত্যাদি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই অনুভব আজ শব্দে প্রকাশ করতে পারব না!” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “আমার সরকারই নেতাজির ফাইল সর্বজনীন করেছে। ২০১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি আজাদ হিন্দ বাহিনীর পুরনো সৈনিকদের দেখে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। আবার ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বছর উপলক্ষে লালাকেল্লায় আমি ওই টুপি পরে তেরঙ্গা উত্তোলন করেছিলাম।”
সব মিলিয়ে আজ তাঁর বক্তৃতায় মোদী সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে নিজের একাত্ম সংযোগের কথা উল্লেখ করার কোনও সুযোগই ছাড়েননি বলে অভিমত রাজনৈতিক মহলের। মোদী জানিয়েছেন ‘যেটা করার সেটা করতেই হবে’— সুভাষের এই চেতনাকে সঙ্গে রেখে এগোচ্ছে তাঁর সরকার। সেই সঙ্গে নিজের জাতীয়তাবাদের রাজনীতির পরাকাষ্ঠা হিসাবে তিনি দাঁড় করাতে চেয়েছেন সুভাষচন্দ্রের রাষ্ট্রবাদকে। মোদীর কথায়, “সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন ভারতে রাষ্ট্রবাদ এমন ইতিবাচক শক্তির জন্ম দেয়, যা অনেক বছরের ঘুম ভাঙাতে পারে। এই রাষ্ট্রচেতনাকে জীবন্ত রাখতে হবে।”
প্রসঙ্গত গত শুক্রবার ইন্ডিয়া গেট থেকে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ সরানো নিয়ে বিরোধিতার মধ্যেই, মোদী হঠাৎ ইন্ডিয়া গেটে সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি বসানোর ঘোষণা করেন। রাজনৈতিক শিবিরের মতে, প্রথম সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার কথা মাথায় রেখেই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটির কথা শেষ মুহূর্তে ঘোষণা করে মোদী সরকার। কারণ ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ সরানো নিয়ে আপত্তি তুললেও নেতাজির মূর্তি বসানো নিয়ে আপত্তি করাটা সম্ভব ছিল না কংগ্রেসের। উল্টে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহই গান্ধী পরিবার তথা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্রের অবদানকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অভিযোগ তুলে আসছেন বিভিন্ন সুযোগে। এ দিন অমিত শাহ বলেছেন— “এ শুধু গ্র্যানাইট মূর্তি নয়, মহান ব্যক্তিত্ব সুভাষচন্দ্রের প্রাপ্য মর্যাদা— দেশের জন্য যিনি সর্বস্ব দিয়েছেন।” কংগ্রেসের পাল্টা প্রশ্ন, সংসদে সুভাষচন্দ্রের মূর্তিতে প্রধানমন্ত্রী কত বার শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছেন? আজাদ হিন্দ ফৌজের মোকাবিলায় ব্রিটিশদের বাহিনী তৈরি করতে সাভারকর সাহায্য করেছিলেন। ১৯৪০-এ সাভারকর হিন্দু যুবকদের দলে দলে ব্রিটিশ সেনায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। সুভাষচন্দ্রকে পরাস্ত করার ডাক দেন। ফলে কংগ্রেসের দাবি, আজ সঙ্ঘী এবং বিজেপির অধিকারই নেই সুভাষচন্দ্রকে স্মরণ করার।