গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
ঠিক সাড়ে চার মাসের মাথায় লোকসভার সাংসদপদ ফিরে পেলেন রাহুল গান্ধী। সোমবার লোকসভায় বাদল অধিবেশন শুরুর কিছু ক্ষণের মধ্যেই লোকসভার সচিবালয় থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, স্পিকার ওম বিড়লার নির্দেশে রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হল। দুপুরে বাদল অধিবেশনে যোগ দিতে সংসদ ভবনে হাজির হলেন তিনি। ওয়েনাড়ের সাংসদকে সংবর্ধনা জানাতে তাঁর দল কংগ্রেসের পাশাপাশি ‘তৎপর’ ছিলেন বিজেপি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র অন্যান্য দলের নেতারাও। সংসদ ভবনের পাশাপাশি কংগ্রেসের সদর দফতর ২৪ আকবর রোডেও দেখা গিয়েছে উন্মাদনা।
সোমবার বিকেলে ‘ইন্ডিয়া’ সূত্রের খবর, মঙ্গলবার বিরোধীদের তরফে অনাস্থা বিতর্কের সূচনা করবেন কেরলের ওয়েনাড়ের সাংসদপদে প্রত্যাবর্তন করা রাহুল। সে ক্ষেত্রে লোকসভা ভোটের আগে ‘মোদী বনাম রাহুল’ লড়াই নতুন মাত্রা পাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে বিরোধী জোটের ‘প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী’ হিসাবে রাহুলের নাম ঘোষিত হয়নি। কিন্তু শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ এবং তার পরে সংসদে রাহুলের প্রত্যাবর্তন জাতীয় স্তরে মোদীর ‘বিকল্প’ হিসাবে রাহুলের নাম আলোচনায় এনে দিল বলে মনে করছেন তাঁরা।
গত ২৩ মার্চ ‘মোদী’ পদবি অবমাননা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে দু’বছর জেলের সাজা পাওয়ায় সাংসদ পদ খারিজ হয়ে যায় রাহুলের। শুক্রবারই সুপ্রিম কোর্টের তরফে রাহুলের সেই শাস্তির নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। সেই স্থগিতাদেশের ৪৮ ঘণ্টা পরেই রাহুলকে তাঁর সাংসদ পদ ফিরিয়ে দেন লোকসভার স্পিকার। সোমবার দুপুর ১২টার কিছু আগে লোকসভায় আসেন রাহুল।
গত ২৬ জুলাই ‘ইন্ডিয়া’র তরফে মোদীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে নোটিস জমা দিয়েছিলেন কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈ। সেই সঙ্গে তেলঙ্গানার শাসকদল বিআরএসের হয়ে পৃথক ভাবে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস জমা দিয়েছিলেন লোকসভার সাংসদ নামা নাগেশ্বর রাও। লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা জানান, সেই অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে মঙ্গলবার (৮ অগস্ট) আলোচনা শুরু হবে সংসদে। ১০ অগস্ট অনাস্থা প্রস্তাবের জবাবি বক্তৃতা করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
সংসদীয় বিধি অনুযায়ী লোকসভার স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস গ্রহণ করার ১০ দিনের মধ্যেই তা নিয়ে সংসদে বিতর্কের সূচনা হওয়ার কথা। এ বিষয়ে দিন নির্ধারণের ক্ষমতা একমাত্র স্পিকারের। সেই বিধি মেনেই ২৬ জুলাই জমা পড়া অনাস্থা নোটিসের ভিত্তিতে মঙ্গলবার লোকসভার স্পিকার ওই সিদ্ধান্ত নেন। ঘটনাচক্রে, সংসদের চলতি বাদল অধিবেশন শেষ হচ্ছে ১০ অগস্ট। বিরোধীরা ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছে, বাদল অধিবেশনের শেষ তিনটি দিনই কেন বরাদ্দ হল অনাস্থা নিয়ে বিতর্কের জন্য?
অবশ্য বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব আনলেও মোদী সরকারের পতনের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। কারণ, ৫৪৩ সাংসদের লোকসভায় সরকারের পতন ঘটানোর জন্য প্রয়োজন ২৭২ সাংসদের সমর্থন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সাংসদ সংখ্যা ৩৩২। এই আবহে রাহুলের বক্তৃতা নিয়ে প্রবল কৌতূহল তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
খড়্গে-ডেরেকদের মিষ্টিমুখ
গত ২৩ মার্চ ওই মামলায় রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করে সুরাত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক হরিশ বর্মা দু’বছরের জেলের সাজা দিয়েছিলেন। এর পর জেলা দায়রা আদালত এবং গুজরাত হাই কোর্ট সেই রায় বহাল রেখেছিল। কিন্তু গত শুক্রবার (৪ অগস্ট) বিচারপতি আরএস গাভাইয়ের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ মোদী পদবি অবমাননা মামলায় গুজরাতের সুরাত আদালতের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দেয়। ফলে রাহুলের সাংসদপদ ফিরে পাওয়া কার্যত নিশ্চিত হয়।
সোমবার দুপুরে লোকসভার স্পিকারের সচিবালয় থেকে জারি করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘যে হেতু রাহুল গান্ধীকে দোষী সাব্যস্ত করার সিদ্ধান্তে স্থগিতাদেশ দিয়েছে আদালত, তাই আপাতত তাঁর সাংসদ পদ খারিজের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হল।’’ ওই বিবৃতির পরেই সংসদে বিরোধীদের আলোচনা কক্ষে উদ্যাপনের মেজাজ দেখা যায়। কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরীকে দেখা যায় কংগ্রেস প্রধান মল্লিকার্জুন খাড়্গেকে মিষ্টিমুখ করাতে। খড়্গে তাঁর পাশে বসা তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মিষ্টিমুখ করান। উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন-সহ অন্যান্য বিরোধী জোটের শরিক দলের সদস্যরাও। প্রত্যেককেই মিষ্টিমুখ করানো হয়।
গান্ধীমূর্তিতে মালা দিয়ে সাংসদে রাহুল
রাহুল সোমবার দুপুর ১২টা নাগাদ সংসদ ভবনে এসে সংসদ ভবনের বাইরে মহাত্মা গান্ধীর মূর্তিতে মালা দিয়ে প্রণাম জানান রাহুল গান্ধী। তার পর প্রবেশ করলেন সংসদে। তাঁর পরনে ছিল সাদা রঙের শার্ট এবং কালো ট্রাউজার্স। রাহুলকে ঘিরে দেখা যায় বিরোধী সাংসদদের ভিড়। পুরনো সংসদ ভবনের দোতলার বারান্দাতেও ভিড় উপচে পড়ে রাহুলকে দেখার জন্য।
সংসদ ভবনে ঢুকে রাহুল প্রথমে কংগ্রেস সাংসদদের জন্য নির্ধারিত ঘরে যান। মা সনিয়া গান্ধীর পাশে বসতে দেখা যায় তাঁকে। কংগ্রেসের সংসদীয় দলের চেয়ারপার্সন সনিয়ার সঙ্গে তখন বৈঠক করছিলেন মণিপুর থেকে আসা নেতারা। তাঁর অন্য পাশে বসেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে। পরে দুপুর ২টোয় লোকসভার অধিবেশন শুরু হলে রাহুল অধিবেশন কক্ষে যান। সেখানেও তাঁকে স্বাগত জানানোর পালা চলে।
১০ জনপথ, ২৪ আকবর রোডে উৎসব
রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ ফিরে পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই সনিয়ার বাসভবন ১০ জনপথ রোডের বাংলো এবং ২৪ আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর দফতর চলে গিয়েছিল কংগ্রেস সমর্থকদের দখলে। ঢোল-নাকাড়া নিয়ে নেমে পড়েন কংগ্রেস সমর্থকেরা। আনন্দে নাচতে দেখা যায় তাঁদের। চলে মিষ্টিমুখের পালা। কংগ্রেসের রীতি মেনেই স্লোগান ওঠে, ‘দেশ কা নেতা ক্যায়সা হো...’।
টুইটারে সরল ‘অযোগ্য সাংসদ’ পরিচয়
সাংসদ পদ ফিরে পাওয়ার পর নিজের টুইটার (অধুনা এক্স) হ্যান্ডলের ‘বায়ো’ বা সংক্ষিপ্ত পরিচয় বদলে ফেললেন রাহুল গান্ধী। গত ২৪ মার্চ সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার পরও এই ‘বায়ো’ বদলে ফেলেছিলেন রাহুল। ‘অযোগ্য সাংসদ’ পরিচয়ের আগে সেখানে স্থান পেয়েছিল ‘কংগ্রেস নেতা’ হিসাবে তাঁর পরিচিতির দিকটি। সোমবার অবশ্য রাহুলের টুইটার বায়োতে লেখা ছিল ‘মেম্বার অফ পার্লামেন্ট’। অর্থাৎ, লোকসভার সদস্য।
গত মার্চ মাসে রাহুল যখন টুইটারের বায়ো বদলে ফেলেন, তখন সেখানে লেখা ছিল, “এটি রাহুল গান্ধীর অফিশিয়াল অ্যাকাউন্ট। তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য।” এর পরেই নতুন শব্দবন্ধ জোড়ে অ্যাকাউন্টে। লেখা হয়, ‘ডিস্’কোয়ালিফায়েড এমপি’ (অযোগ্য সাংসদ)। আভিধানিক বানান ‘ডিস্কোয়ালিফায়েড’-এর বদলে রাহুল ডিস্’কোয়ালিফায়েড কেন লিখেছিলেন, তার ব্যাখ্যা অবশ্য পাওয়া যায়নি। মনে করা হয়, নিজের সাংসদ পদ খারিজ নিয়ে বিদ্রুপ করতে সচেতন ভাবেই ওই বানান লেখেন রাহুল। গত চার মাস ধরে ওই ‘বায়ো’ই জ্বলজ্বল করেছে তাঁর টুইটার হ্যান্ডলে।
ফিরে পাবেন তুঘলক লেনের বাংলো?
সুরাত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের রায়ের পরেই মালপত্র সরানো শুরু করেছিলেন। ২০ এপ্রিল সুরাতের দায়রা আদালত ‘মোদী’ পদবি নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের দায়ে সাজা বহাল রাখার পরেই সাংসদ হিসাবে পাওয়া দিল্লির বাংলো ছেড়ে দিয়েছিলেন বরখাস্ত সাংসদ রাহুল গান্ধী। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট সেই সাজায় স্থগিতাদেশ দেওয়ার পরে লোকসভায় স্পিকার ওম বিড়লা ওয়েনাড়ের সাংসদকে তাঁর পদ ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর সেই সঙ্গেই ১২ নম্বর তুঘলক লেনের সেই সরকারি বাংলোর ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন জল্পনা। যদিও রাহুল সোমবার বাংলো ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘মায়ের সঙ্গে তাঁর বাংলোয় থাকতে আমার অসুবিধা হচ্ছে না। এটাও চাইলে ছিনিয়ে নিতে পারে (মোদী সরকার)। আমি জানি, ভারতের মানুষ আমাকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দেবেন।’’
রাহুলের আগে তাঁর বোন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরাকেও লোদী এস্টেটের সরকারি বাংলো থেকে উৎখাত করেছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। তিনি এখন বেসরকারি আবাসনে থাকেন। রাহুল ভারত জোড়ো যাত্রায় বলেছিলেন, ৫২ বছর বয়স হয়ে গেলেও তাঁর নিজস্ব বাড়ি নেই। কংগ্রেস সূত্রের খবর, দিল্লির প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের ছেলে সন্দীপ, তাঁর নিজের একটি বাড়ি রাহুলকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি ‘জেড প্লাস’ নিরাপত্তা পাওয়া রাহুলের উপযুক্ত নয় বলে জানিয়েছিলেন তাঁর নিরাপত্তা অধিকারিকেরা। এই পরিস্থিতিতে সাংসদ পদ ফিরে পাওয়ায় সেই সমস্যা মিটল বলেই মনে করা হচ্ছে। ১২ তুঘলক লেনের বাংলোটি এখনও কাউকে বরাদ্দ করেনি লোকসভা সচিবালয়। সেই বাংলোই এ বার তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হতে পারে বলে কংগ্রেসের একটি সূত্র জানাচ্ছে।