গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লাইনে দাঁড় করিয়ে মাথা গুনে নিয়েছিল সরকার। খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছিল ঠিকুজি-কুষ্ঠি। তা সত্ত্বেও জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা (এনআরসি) য় জায়গা হল না ১৯ লক্ষ ‘অসমবাসী’র। এত দিন যে ছাদের নীচে দিন কেটেছে, তিলে তিলে যে সংসার গড়ে তুলেছেন, তার মালিকানা পেতেই এ বার আইন-আদালতের চক্কর কাটতে হবে তাঁদের। বিপুল ক্ষমতায় নিয়ে মসনদে ফেরা কেন্দ্রীয় সরকারের বিধান এমনই। তাতে নতুন করে ফের একবার উদ্বেগের ছায়া নেমে এসেছে গোটা রাজ্যে।
এর আগে, ২০১৮-র ৩০ জুলাই নাগরিক পঞ্জির খসড়া প্রকাশ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। সেইসময় তালিকা থেকে বাদ পড়েছিলেন ৪১ লক্ষ মানুষ। তাই গত একবছর ধরে চূড়ান্ত তালিকার দিকে তাকিয়েছিল গোটা দেশ। সকাল ১০টায় সরকারি ওয়েবসাইটে তালিকা প্রকাশ হওয়ার কথা থাকলেও, সকাল থেকেই টিভির পর্দায় চোখ আটকে ছিল উৎকণ্ঠিত মানুষের। ফলাফল সামনে আসার পর স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন খসড়া-ছুটদের অনেকেই। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকায় নাম না ওঠা লক্ষ লক্ষ মানুষ ফের লম্বা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
নাগরিকপঞ্জির খসড়া প্রস্তুত নিয়ে আগেই সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন এনআরসি কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনেই গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে যদিও দাবি করেছেন তিনি। কিন্তু তালিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদে নেমে পড়েছে আসু এবং অসম পাবলিক ওয়ার্কসের মতো সংগঠনগুলি। তাঁদের দাবি, গোটা রাজ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বা বিদেশির সংখ্যা প্রায় ৮০-৯০ লক্ষ। সেখানে চূড়ান্ত তালিকায় মাত্র ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম কেন?
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আরও পড়ুন: অসমে চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা প্রকাশ, বাদ পড়লেন ১৯ লক্ষ
চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের চূড়ান্ত সময়ে প্রতীক হাজেলার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে রাজ্যের প্রভাবশালী বিজেপি নেতা ও মন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা স্পষ্ট বলেছেন, এই এনআরসি নাগরিকত্ব প্রমাণের শেষ কথা তো নয়ই, এমনকী এই তালিকা কোয়ার্টার ফাইনালও নয়। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারই পরে এনআরসি নিয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেবে। ফলে যাদের নাম ওঠেনি তাদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। সরাসরি মুসলিমদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা দক্ষিণ সালমারা, ধুবড়ির মতো এলাকার অনু প্রবেশ কারী মানুষের ‘বাদ পড়ার সংখ্যা কম’। হিমন্ত সাফ বলেছেন, এই এনআরসি অসমকে বিদেশি মুক্ত করতে পারবে না। তাছাড়া হিমন্ত বিশ্ব শর্মা আজ বলেছেন ,১৯৭১ সালের আগে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা বাসিন্দাদের নাম এনআরসি তালিকায় নেই। কারণ, তাঁদের রিফিউজি সার্টিফিকেট নেননি কর্তৃপক্ষ। অথচ যেভাবেই হোক রিফিউজি সার্টিফিকেট নেওয়া হোক , এই দাবিতে রাজ্য বিজেপির জোরদার আন্দোলন বা দাবির অবশ্য নজির নেই। আবার এই মন্ত্রী বরাবরই দাবি করে আসছেন অসমে বিদেশি বাছাইযের ভিত্তিবর্ষ হোক ১৯৫১ সাল।
অন্যদিকে ,গত এক মাস থেকে রাজ্য বিজেপি এনআরসি এবং প্রতীক হাজেলা নিয়ে তাদের রণনীতি সম্পূর্ণ বদলে ফেলে তীব্র বিরোধিতায় সোচ্চার। আসলে হিমন্ত সেই সুরেই নিজের সুর বসিয়ে চূড়ান্ত তালিকাছুটদের সান্ত্বনা দিতে উদ্যোগী হয়েছেন দলের হয়ে ড্যামেজ কন্ট্রোল করার জন্য।
৩.৩ কোটি বাসিন্দার ৬.৬ কোটি নথির ভিত্তিতে তৈরি এই এনআরসি প্রক্রিয়া। রাজ্যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী টহলরত। হোমগার্ড, টাস্ক ফোর্স,ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি মোতায়েন করা হয়েছে। ৫১ কোম্পানি ফোর্স। বাদ পড়ারা আজ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে বিদেশি ট্রাইব্যুনালে অনেক টাকা পয়সা ও হয়রানি খরচ করে আবেদন করবেন।
আরও পড়ুন: এনআরসি তালিকায় নাম খুঁজবেন কী ভাবে, নাম না থাকলে কী করতে পারেন
তালিকা থেকে নাম বাদ পড়েছে বলে এখনই কাউকে বিদেশি বলে দেগে দেওয়ার সম্ভাবনা যদিও নেই। ১২০ দিনের মধ্যে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন ওই সমস্ত মানুষ। আবার ট্রাইব্যুনালে মামলা হেরে গেলে, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগও রয়েছে। কিন্তু কত দিনে সেই প্রক্রিয়া শেষ হবে, সেই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। সাধারণ মানুষের ১ হাজার ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে অসমের এই এনআরসি অসম ও অসমের বাইরেও কয়েক কোটি মানুষকে অস্তিত্বের পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। আতঙ্কে ইতিমধ্যেই ৫৮ জনের প্রাণ গিয়েছে। নাগরিক বাছাইয়ের নামে এই বিভাজন প্রক্রিয়া সমাজ এবং জনমানসে কী দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করছে, তা বুঝতে আরও যুঝতে হবে অসমবাসীকে। যুঝতে হবে গোটা দেশকেও।
লেখক বরাক উপত্যকার সংবাদকর্মী।