‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া’য় পাঞ্জাবের রাজ সুইৎজারল্যান্ডে গিয়ে দেখা পেয়েছিলেন সিমরনের। জয়পুরের অটো চালক ‘রাজ’-এর গল্পও কিছুটা ওই ফিল্মের মতোই। তবে তাঁর ‘সিমরন’ ফ্রান্স থেকে বেড়াতে এসেছিলেন জয়পুরে। আর এখন দু’জনে সংসার পেতেছেন সুইৎজারল্যান্ডে।
জয়পুরের রাজের পুরো নাম রণজিৎ সিংহ রাজ। পড়াশোনা কোনও দিনই ভাল লাগেনি তাঁর। ক্লাস টেনও পাস করতে পারেননি। ১৬ বছর বয়স থেকেই অটো চালাতে শুরু করেন।
এখন সেই রাজই জেনেভার বাসিন্দা। নিজের ইউটিউব চ্যানেল আছে। গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলেন। কথা বলতে পারেন ফরাসি ভাষাতেও।
জয়পুরের রাস্তা থেকে জেনেভা পর্যন্ত রাজের এই উত্থানকে রাজকন্যার সঙ্গে অর্ধেক রাজত্ব পাওয়া বললে অত্যুক্তি হয় না।
নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম রাজের। সিনেমার রাজের মতো ধনী নন তিনি। আর্থিক অনটন আর রূপ নিয়ে অনেক কুকথা শুনতে হয়েছে। একটা সময় সে সব অভ্যাসেই পরিণত হয়েছিল। তবে রাজ জানিয়েছেন তিনি কখনও দমে যাননি।
ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির জন্য অটোযাত্রীদের কাছে অপমানিত হওয়া নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। এমনকি রাস্তাঘাটে ভুল কারণে মার পর্যন্ত খেতে হয়েছে তাঁকে। সিনেমার রাজের মতো তাঁর জীবনে কোনও অমরীশ পুরী না থাকলেও কম হেনস্থার শিকার হতে হয়নি তাঁকে।
তাতে অবশ্য রাগও হয়েছে প্রবল। মনে হয়েছে, গরিবদের সঙ্গে কি যা খুশি তা-ই করা যায়? গরিব হওয়া কি অপরাধ? তবে শেষপর্যন্ত অপমানগুলো মুখ বুজেই সহ্য করেছেন রাজ।
তাঁর জীবনের মোড় হঠাই ঘুরে যায়, যখন রাজ লক্ষ্য করেন অন্য অটোচালকরা বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য বিদেশি ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছেন। ব্যবসায়িক বুদ্ধি চাগাড় দিয়ে ওঠে রাজের। ঠিক করে নেন, তিনিও বিদেশি ভাষা বলবেন।
ইংরেজি শেখার পাশাপাশি নিজের পর্যটনের ব্যবসাও শুরু করে দেন রাজ। বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে নিয়ে রাজস্থানের বিভিন্ন জায়গা দেখানোর কাজ শুরু করেন। হবু স্ত্রী-র সঙ্গে তেমনই এক সফরে দেখা হয় রাজের।
ফ্রান্সের ওই তরুণী ভারতে ঘুরতে এসেছিলেন বান্ধবীদের সঙ্গে। জয়পুরের ট্যুরিস্ট গাইড রাজের প্রেমে পড়ে যান তিনি।
বান্ধবী ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার পরও দু’জনের কথাবার্তা চলতে থাকে ভিডিয়ো কলে। দু’জনেই ঠিক করে ফেলেন, দেখা করতে হবে। কিন্তু বাদ সাধে ফরাসি দূতাবাস। রাজের ভিসার আবেদন বাতিল হতে থাকে বার বার।
বাধ্য হয়ে ফের ভারতে আসেন রাজের বান্ধবী। ফরাসি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে দু’জনেই ধরণায় বসেন দূতাবাসের বাইরে। তাতে কাজ হয়। রাজকে ৩ মাসের ভিসা দেয় ফরাসি দূতাবাস।
২০১৪ সালে বিয়ে করেন দু’জনে। এ বার দীর্ঘমেয়াদি ভিসার জন্য আবেদন করেন রাজ। ফরাসি দূতাবাস জানিয়ে দেয়, ভিসা পেতে হলে ফরাসি ভাষা শিখতে হবে। সেই ভাষাও শিখে নেন রাজ।
কর্মসূত্রে রাজ এখন সুইৎজারল্যান্ডের বাসিন্দা। সে দেশের একটি রেস্তরাঁয় কাজ করেন তিনি।
এর পাশাপাশি একটি ইউটিউব চ্যানেলও চালান রাজ। দর্শকদের সঙ্গে নিজের জীবনেরই টুকরো টুকরো মুহূর্ত ভাগ করে নেন সেই চ্যানেলে। তার সঙ্গে শেখান রান্নাও।
রাজের রান্না শেখা অবশ্য ফ্রান্সে এসেই। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে মানুষ চিজ, পাস্তা আর ঝলসানো মাংস খায়। আমার পোষাচ্ছিল না। নিজের তাগিদেই রান্না শেখা শুরু করি। আর এখন জোর দিয়ে বলতে পারি রান্নাটা ভালই করতে পারি।’’
এতটাই ভাল যে পেশা হিসেবে এখন রেস্তরাঁ খোলার কথা ভাবছেন রাজ। সেখানেও নিজেই রান্না করার ইচ্ছে আছে তাঁর।
আপাতত জেনেভাতেই দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন রাজ।
রাজ মনে করেন ডিগ্রি বা স্কুলছুট হওয়া জীবনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে না। সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করে জীবনের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গীর উপরে। ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিলে নিজের আবেগের কথা শুনলে এবং পরিশ্রম করলে সাফল্যকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।