মহুয়া মৈত্র। —ফাইল চিত্র।
সাংসদ পদ খারিজের সুপারিশ করা রিপোর্টে সংসদীয় এথিক্স কমিটি সিলমোহর দেওয়ার পরেই মহুয়া মৈত্র বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি রণক্ষেত্র ছাড়বেন না। বলেছিলেন, তিনি পরের লোকসভায় দ্বিগুণ ভোটে জিতে আসবেন। আজ বিভিন্ন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই দাবিতে অটল থেকে মহুয়া জানিয়েছেন, মোদী এবং আদানির ‘শেষ দেখে’ তিনি ছাড়বেন। এই বহিষ্কারের নির্দেশ তাঁর কাছে ‘শাপে বরের’ সামিল। মহুয়ার দাবি, সামনে ‘সুবর্ণ সুযোগ’, কারণ কৃষ্ণনগরে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তাঁর সঙ্গে দল রয়েছে এবং তিনিও যে দলের একান্ত সৈনিক—এ কথাও আজ বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ।
আজ দুপুরে নিজের এক্স হ্যান্ডলে মহুয়া শিল্পপতি গৌতম আদানিকে সম্বোধন করে লেখেন, “মিস্টার আদানি, মহুয়ার টিকিট কাটা যাবে এ কথা সবাইকে বলে নিজের সময়
নষ্ট করবেন না। আমি কৃষ্ণনগর থেকেই দাঁড়াব, আমার জয়ের ব্যবধান দ্বিগুণ হবে।”
এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “বিজেপি বোকা। আমাকে খলনায়িকা বানানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু আমার মনে হয়, আমি নায়িকাই হয়ে উঠছি। কারণ, জনগণ সব বুঝতে পারছেন কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে। এখনও আমার সাংসদ পদ বাতিল হয়নি। আগামী ৪ ডিসেম্বর সংসদে শীতকালীন অধিবেশন। সেখানেই বোঝা যাবে কী হয়। তবে আমার পদ আজ খারিজ করলে আগামীতে আবার ফিরবই।”
সূত্রের খবর, এথিক্স কমিটির রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, নিজের পাসওয়ার্ড নিয়ম বহির্ভূত ভাবে অন্যকে দিয়েছিলেন মহুয়া। এতে লঙ্ঘিত হয়েছে জাতীয় সুরক্ষার মতো বিষয়। এ বিষয়ে মহুয়ার মন্তব্য, ‘‘৬১ বার প্রশ্নের জন্য ৪৭ বার লগ ইন হতেই পারে। ন’টি প্রশ্ন হয়েছে আদানি নিয়ে। বাকি ৫২টি প্রশ্ন তো অন্য বিষয় নিয়ে। বন্ধুর অফিসের টাইপিস্ট প্রশ্নগুলো তুলেছিল। আমি আমার বন্ধুর অফিসের টাইপিস্টকে দিয়ে এই কাজ করাই, কি ভাগ্নিকে দিয়ে করাই, সেটা আমার ব্যাপার। আমার কাছে ওটিপি আসে। এই নিয়ে যদি এতই সমস্যা থাকবে, তা হলে এনআইসি-র কোনও আইন নেই কেন। যখন চিন আমাদের দু’কিলোমিটার জমি নিয়ে নেয়, কোনও বিমানবন্দর চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও আদানিকে সব বিমানবন্দর তুলে দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে তো নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না!’’
সময়ের আগে এথিক্স কমিটির খসড়া রিপোর্ট কী ভাবে সংবাদমাধ্যমের কাছে এল, তা নিয়ে ফের সরব হয়েছেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমাদের একটা আইন আছে ২৭৫(২), এথিক্স কমিটিতে যা থাকে তা বাইরে বেরোয় না। এখানে দেখলাম তারা বাইরে বলে দিচ্ছে। যিনি এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান, তিনি তাঁর নিজের নাম ঠিক করে বলতে পারেন না। এথিক্স কমিটি নিজেদের হাস্যকর করে তুলেছে। প্রমাণ নেই, তদন্তের আগে সুপারিশ করে দিচ্ছে।’’
এমন বিতর্কের পরে প্রশ্ন উঠছে, চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে আদৌ কি টিকিট পাবেন মহুয়া? তাঁর কথায়, “আমার নির্বাচনী ক্ষেত্রের গ্রামগুলিতে গিয়ে দেখুন। আগে একশো লোক এলে আমার কথা শুনতে এখন অনেক বেশি মানুষ আসছেন। বিমানবন্দর দিয়ে হেঁটে গেলে আগে যত লোক কথা বলতে আসতেন, এখন তার থেকে অনেক বেশি লোকের ভিড় হচ্ছে। আমার রাজনীতির ৩০ বছর বাকি রয়েছে। পাঁচ বছর কি সাত বছর, আমি মোদী-আদানির শেষ দেখে ছাড়ব।”
গতকাল তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রথম দেখা যায় মহুয়ার বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে। তিনি এক দিকে যেমন বলেছেন, ‘সাংসদ নিজের লড়াইটা নিজেই লড়ে নেবেন’, আবার এটাও বলেছেন, ‘মহুয়া রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।’ এ দিন মহুয়া বলেন, ‘‘আমি দলের প্রতীকের বাইরে নই। তবে আমিও মেরুদণ্ড সোজা করে লড়াই চালাচ্ছি। আমার সাথে দলের বিভাজন আছে, এমনটা বিজেপি বলে বেড়ায়। আমি দলের সাথে, দল আমার সাথে আছে।’’
মহুয়ার কথায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও একই ভাবে ইডি দিয়ে হেনস্থা করা হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগকারী বিজেপি-র ঝাড়খণ্ডের সাংসদ নিশিকান্ত দুবে সম্পর্কেও ঝাঁঝালো মন্তব্য করেছেন মহুয়া, নাম না করে। বলেছেন, “ঝাড়খণ্ডের অশিক্ষিত সাংসদ, যাঁর নামও নিতে চাই না, তাঁর সব ডিগ্রিই জাল। বিএ ডিগ্রি জাল হলে কী ভাবে তাঁর ডক্টরেট হয়, সেটা তো বুঝলাম না! তিনি আবার বলছেন, লোকপাল নাকি আমার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নোটিস দিয়েছে। অথচ লোকপাল অফিসই এ ব্যাপারে কিছু বলল না!”
তৃণমূলের সাংসদের পাশে আজও দাঁড়িয়েছেন লোকসভায় বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতা তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। মহুয়া যে অভিযোগ করেছেন ক্যাঙ্গারু কোর্টে তাঁর বিচার হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে এ দিন অধীর বলেছেন, ‘‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট তো বটেই। তথ্য-প্রমাণ নেই, ফাঁসি দিয়ে দিল! মহুয়া মৈত্র যে টাকা নিয়েছেন, তার কোনও প্রমাণ আছে? তারা নিশ্চয় বিনা পয়সায় প্রশ্ন করে না বলেই ধরে নিয়েছে যে, প্রশ্ন যখন করেছে আদানিদের বিরুদ্ধে, টাকা নেওয়া হয়েছে। তার পরে তাঁকে সাজা দিয়ে দেওয়া হল, সংসদ থেকে তাঁকে বার করে দেওয়া হোক। এটাকে বলা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের রংবাজি!’’
হুগলির খানাকুলে এ দিনই বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আবার মহুয়াকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বলেন, ‘‘ওই সাংসদের চশমা, ঘড়ি, ব্যাগের দাম দু’-তিন লক্ষ টাকা করে। ওঁর ৭০ লক্ষ টাকার ৩৫ জোড়া জুতোই আছে। এ সব টাকা সাধারণ মানুষের থেকে লুটের টাকা।’’ পরে সাংবাদিকদের দিলীপ বলেন, ‘‘মহুয়া আগামী দিনে যাতে ভোটে দাঁড়াতে না পারেন, তার ব্যবস্থাও করা উচিত।’’