রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে বিতর্ক। ছবি রাজ্যসভা টিভির সৌজন্যে
লোকসভার পর রাজ্যসভাতেও পাশ হয়ে গেল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি)। ভোটাভুটিতে ১২৫টি ভোট পড়েছে বিলের পক্ষে। বিপক্ষে ভোট ১০৫টি। এ বার রাষ্ট্রপতি সই করলেই এই বিল আইনে পরিণত হবে।
মূল এই ভোটাভুটির আগে বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হবে কি না, তা নিয়ে ভোটাভুটি হয়। মোট ১৪টি সংশোধনীর জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিভিন্ন দলের সাংসদরা। কিন্তু ভোটাভুটিতে সবকটিই খারিজ হয়ে গিয়েছে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে রাজ্যসভায় জোর বিতর্ক হয়। সোমবার লোকসভায় পাশ হওয়ার পর আজ বুধবারই রাজ্যসভায় পেশ হয় এই বিল। তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয় শাসক ও বিরোধী পক্ষের সাংসদের মধ্যে।
এ দিন রাজ্যসভায় আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে অমিত শাহ দাবি করেন, ‘‘লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে ধর্মীয় প্রতারণা হয়েছে। এই বিলের মাধ্যমে সেই সব শরণার্থীদের অধিকার দেওয়া হবে।’’ এ দেশে বসবাসকারী মুসলিমদের আশঙ্কার কোনও কারণ নেই আশ্বাস দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সন্ধ্যার দিকে জবাবি বক্তৃতায় অমিত শাহ বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশে এই বিল আনা হয়নি। আগের সরকার বিষয়টির যথাযথ মোকাবিলা করতে পারেনি।
বিরোধী কংগ্রেসের পক্ষে বিজেপিকে আক্রমণ শানিয়ে আনন্দ শর্মা বলেন, ‘‘এই বিল ‘ভারতের আত্মার উপরে আঘাত।’’ বিল নিয়ে বিজেপি কেন তাড়াহুড়ো করছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। সেই সঙ্গে দেশ ভাগের জন্য কংগ্রেস দায়ী বলে অমিত শাহ লোকসভায় যে অভিযোগ করেছিলেন তারও জবাব দিয়েছেন আনন্দ শর্মা। দেশ ভাগ নিয়ে সরাসরি হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগকে দায়ী করেছেন তিনি। অমিত শাহের কথার সূত্র ধরেই বিজেপিকে তোপ দেগেছে তৃণমূল কংগ্রেসও। নোটবন্দির কথা তুলে দলের সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, ‘‘আপনারা আশ্বাস দিলেও, সিএবি নিয়ে আশঙ্কার কারণ আছে। কারণ, নোটবন্দির সময়েও প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ফল কী হয়েছে তা সবাই জানেন।’’
সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্য়ায় বলেন
• জাতীয় সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলেছিলেন
• এই বিলে বিশ্বকবির সেই ধারণা ধাক্কা খাবে
• আঘাত পাবে ঐক্যবদ্ধ ভারতের ধারণাও
এমডিএমকে সাংসদ ভাইকো বলেন
• এই বিল আপত্তিজনক, অগণতান্ত্রিক, অযৌক্তিক, অসাংবিধানিক
• এই বিল পাশ হলে তা হবে রাজ্যসভার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়
• এই বিল বঙ্গোপসাগরে ছুড়ে ফেলা উচিত
কপিল সিব্বল বলেন
• অমিত শাহ লোকসভায় বলেছিলেন, কংগ্রেস ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের জন্য দায়ী
• আমি জানি না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোন ইতিহাস বইয়ে এটা পড়েছেন
• দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা সাভারকর
• আমি অমিত শাহকে এই মন্তব্য প্রত্যাহার করতে বলব
• কারণ, কংগ্রেস ধর্মের বিভাজনে বিশ্বাস করে না
• অমিত শাহ বলেছিলেন, এটা ঐতিহাসিক বিল
• এর কারণ, ওঁরা ইতিহাস নতুন করে লিখছেন
• স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সকলকে রাজনীতির উপরে উঠতে বলেছেন। আমি অমিত শাহকে বলব আপনি নিজে রাজনীতির উপরে উঠুন
• এই বিল দ্বিজাতি তত্ত্বকে আইনি সিলমোহর দিতে চলেছে
• আপনারা সংবিধান ধ্বংস করে দিতে চলেছেন
• অমিত শাহ বলেছেন, মুসলিমদের কোনও ভয় নেই
• মুসলিমদের কেউই আপনাদের ভয় পায় না
• আপনারা ভারতকে জুরাসিক যুগে নিয়ে যাবেন না
পি চিদম্বরম বলেন
• কেন সরকার শুধু মাত্র তিনটি প্রতিবেশী দেশের কথা বলছে?
• কেন অন্য যে সব দেশের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত রয়েছে তাদের কথা বলা হচ্ছে না?
• শুধু মাত্র ধর্মীয় ভাবে নিগৃহীতদেরই কথা কেন বলছে সরকার?
• এই বিভাজন অযৌক্তিক
• কেন পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশকে এক পংক্তিতে রেখে বাকি দেশ গুলিকে বাদ দেওয়া হচ্ছে?
• কেন হাজারা এবং আহমদিয়াদের কথা বলা হচ্ছে না?
• আব্রাহামিক ধর্ম তিনটি হলেও কেন শুধু মাত্র ক্রিশ্চান ছাড়া বাকি দুটিকে বাদ দেওয়া হচ্ছে?
• এই বিলের মাধ্যমে সরকার শুধু মাত্র হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাই তুলে ধরছে
• আমি নিশ্চিত যে এই আইন এক দিন মুছে যাবে
ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন
• হিটলারের মতো ভুয়ো প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি
• যাঁরা দেশে রয়েছেন তাঁদের অধিকারই সুরক্ষিত নয়
• সিএবি এবং এনআরসি আলাদা নয়
• আপনারা আশ্বাস দিলেও আশঙ্কার কারণ আছে
• কারণ, নোটবন্দির সময়েও আপনি আশ্বাস দিয়েছিলেন
• কিন্তু, তা সত্ত্বেও সকলে জানেন কী পরিস্থিতি হয়েছিল
• আপনারা ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন
• আপনারা প্রতিশ্রুতি ভাল দেন, তবে প্রতিশ্রুতি ভাঙেন সবচেয়ে বেশি
• নোটবন্দি, জিএসটি, এবং সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের কথা তোলেন ডেরেক
• এ বার আপনারা সিএবি আনতে চাইছেন
• অসমে আপনাদের সিএবি-র পাইলট প্রজেক্ট ব্যর্থ হয়েছে
• সিএবির মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন ঘটাতে চাইছেন
• এই বিল বাংলা বিরোধী, ভারত বিরোধী
• বিজেডি এবং জেডিইউ-কে আবেদন ডেরেকের
• আজ আপনাদের অবস্থান স্থির করতে হবে
• কোন বাটনে চাপ দিচ্ছেন
• ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে সেই উত্তর দিতে হবে আপনাদের
• সিএবি হবে না
জে পি নাড্ডা বলেন
• এ দেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষিত
• তাঁদের সংখ্যা এ দেশে আগের থেকে বেড়েছে
• কিন্তু, পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমেছে
• আপনারা বিষয়টি বুধতে চাইছেন না
• নাগরিকদের সমানাধিকারের উপর এই বিল কোনও আঘাত হানবে না
• উত্তর-পূর্ব ভারতে বিরোধীরা ভুল প্রচার করছে
• কারও জাতি পরিচয় বিনষ্ট হবেনা
• দেশের স্বার্থেই এই বিল
আনন্দ শর্মা বলেন
• ২০১৬ সালের বিলের সঙ্গে এই বিলের অনেক ফারাক
• আমি এই বিলের সঙ্গে সহমত নই
• এই বিলের স্ক্রুটিনি প্রয়োজন
• এই বিল আপনি ঐতিহাসিক বলছেন
• ইতিহাসকে কী ভাবে আপনি দেখেন তা আপনার ব্যাপার
• এই বিল আনার জন্য এত তাড়াহুড়ো কিসের?
• আমরা এই বিলের বিরোধিতা করছি
• বিরোধিতার কারণ রাজনৈতিক নয়, এটা ভারতীয় সংবিধানের উপর আঘাত
• এটা ভারতের আত্মার উপর আঘাত
• এই বিল তার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে
• এই বিল ধর্মীয় নিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে
• কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনি কংগ্রেসের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর দেশভাগের দোষ চাপাচ্ছেন
• এটা ঠিক নয়, এ ভাবে ইতিহাস বদলানো যায় না
• আপনি রাজনীতি করব না বলেও রাজনীতির কথা বলছেন
• অনেক সরকারই নতুন ইতিহাস চেখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি
• দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা ছিল হিন্দু মহাসভা, তার নেতা ছিলেন বিনায়ক সাভারকর
• এই তত্ত্ব মেনে নিয়েছিল মুসলিম লিগও
• হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লিগই লর্ড লিনলিথগোকে চিঠি দিয়েছিল
• আপনারা সে সময়ের ব্রিটিশ শাসকের ভূমিকা কেন অস্বীকার করছেন?
• আপনারা সংখ্যালঘুদের জন্য বিল আনলে তা হলে ওঁদের কথা নেই কেন?
• রাজনীতি না করে এই বিল ফিরিয়ে নিন
• কোনও দল তাদের ইস্তাহারে যা খুশি লিখতে পারেন
• আপনারা দেশ জুড়ে এনআরসি করবেন বলছেন?
• অসমের কী অবস্থা দেখুন, অসম জ্বলছে কেন?
• আপনারা ভাল করতে চাইছেন তো অসমের নাগরিকদের মনে আতঙ্ক কেন?
অমিত শাহ বলেন
• শরণার্থীরা তাঁদের অধিকার পাবেন
• লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে ধর্মীয় প্রতারণা হয়েছে
• এই বিলের মাধ্যমে অধিকার পাবেন শরণার্থীরা
• ভোটের পর রাজনীতি করছি না
• ভোটের আগেই আমাদের কর্মসূচি ছিল
• চিন্তা নেই উত্তর-পূর্ব ভারতের বাসিন্দাদের
• পড়শি দেশ থেকে আসা সংখ্যালঘুরা এ দেশে আশ্রয় পাবেন
• অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত কোনও মামলা চললে তা প্রত্যাহার করা হবে
• সংখ্যালঘুরা এ দেশে সুরক্ষিত থাকবেন
• মুসলিমদের আশ্বাস অমিত শাহের
শাসক শিবির আশাবাদী, বিল পাশে কোনও সমস্যা হবে না। ওই বিল পাশ করাতে শাসক দলের প্রয়োজন ছিল ১২১ জন সাংসদের ভোট। তবে, এ দিন সংসদের উচ্চকক্ষে ৪ সাংসদ অনুপস্থিত। ফলে, ম্যাজিক ফিগার কিছুটা নেমে ১১৯ হয়েছে। রাজ্যসভার মোট আসন ২৪৫। বর্তমানে সাংসদ রয়েছেন ২৪০ জন। রাজ্যসভায় এই মুহূর্তে বিজেপির সাংসদ-সংখ্যা ৮১। আর সব মিলিয়ে এই বিলের পক্ষে সাংসদ আছেন ১২৮ জন। এর মধ্যেই বিজেপির চিন্তা বাড়িয়েছে শিবসেনাও। লোকসভায় শিবসেনা নাগরিকত্ব বিলের পক্ষে ভোট দিলেও, রাজ্যসভার ভোটে বিরোধী শিবিরের সঙ্গে হাত মেলানোর ইঙ্গিত দিয়েছে উদ্ধব ঠাকরের দল।
আরও পড়ুন: মুসলিম হব, বলছেন প্রাক্তন আমলারা
আরও পড়ুন: নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ অসম, ত্রিপুরা, নামাতে হল সেনা
বুধবার সকালেই তাঁর টুইটে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের কড়া সমালোচনা করেছেন রাহুল গাঁধী। লিখেছেন, ‘‘এই বিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে জাতিগত ভাবে বিশুদ্ধ করার চেষ্টা। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উপর অপরাধমূলক আক্রমণ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের পাশেই রয়েছি।’’