কে চন্দ্রশেখর রাও। —ফাইল চিত্র।
নেহাত একের পর এক কড়া পাহারার বৃত্ত। নয়তো বেগমপেট অঞ্চলে কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের (কে সি আর) বাড়ি ‘প্রগতি ভবন’ পর্যটনস্থল ছাড়া আর কী! আট বছর আগে ৫০ কোটি টাকা দিয়ে (তথ্য জানার অধিকার আইনের সুবাদে এই সংখ্যাটি সরকারেরই দেওয়া) তৈরি এই ভবন দূর থেকেও অনন্য। আলপিন পড়ে থাকলেও নজরে আসবে, এমন প্রায় কিলোমিটার খানেক রাস্তা সোজা উঠে গিয়েছে এই শহরের উচ্চাবচ চরিত্র অনুযায়ী। আর তার একেবারে শেষে ধবধবে সাদা অপূর্ব বাংলো। সেখানেই থাকেন বিআরএস-এর সর্বাধিনায়ক। আর এই রাস্তার দু’পাশে ছোট-ছোট আবাসন, অফিস। যার এক-একটির এক-এক রকম কাজ।
দেখা যাচ্ছে, আপাতত সব কাজই ভোটনৈতিক। কংগ্রেস নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুযোগ জানিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনটিকে নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করছেন কে সি আর। অভিযোগই সার। ভোটের মুখে কোন কাজেই বা লাগবে এই বিশাল প্রাসাদে ঘেরা কেসিআর-এর মিনি নগরীটি?
বসে আছি প্রগতি ভবনের ‘ওয়ার রুম’-এ। নামটি যুদ্ধংদেহী হলেও, প্রচারের শেষ বেলায় এই কক্ষ এখন শান্ত। নিবিঢ় বনানি, ইতিউতি পাখি ডাকছে। ‘যোদ্ধারা’ শেষ মুহূর্তের প্রচার সারছেন যে যার নির্বাচনীক্ষেত্রে। ওয়ার রুম আগলে বসে আছেন শৈলেশ রে়ড্ডি, যিনি কে সি আরের পুত্র কে টি আর-এর (কে টি রাম রাও) নিজস্ব বাহিনীর প্রধান। যিনি ভোট প্রচার কৌশলেও আছেন, সাম্বৎসরিক জনসংযোগ রচনাতেও আছেন। রোজ সকালে কে টি আর এই ঘরটিতেই তাঁর সঙ্গে আলোচনা সেরে চপার ধরছেন গত দু’সপ্তাহ।
‘‘দলিতবন্ধু যোজনা এবং গরীব মানুষকে দু’কামরার বাড়ি দেওয়া — এ বার ভোটে এই ছিল আমাদের সব চেয়ে বড় অস্ত্র। প্রতিটি দলিত পরিবারকে এককালীন ১০ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্প সাড়া ফেলে দিয়েছে যেমন, তেমনই পাহাড় প্রমাণ প্রত্যাশাও তৈরি হয়েছে। এক ধাক্কায় সবাইকে দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে যাঁরা পাননি, তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। কংগ্রেস তাঁদের উসকাচ্ছে। জেলায় জেলায় বিআরএস নেতারা পাল্টা তাঁদের বোঝাচ্ছেন।’’— চোস্ত হিন্দি এবং ইংরেজি মিশিয়ে বলছেন শৈলেশ, প্রাক্তন সাংবাদিক ও তেলঙ্গানা আন্দোলনের অন্যতম মুখ।
বিভিন্ন জেলা থেকে কংগ্রেসের যে তরঙ্গের খবর আসছে, সেটা তা হলে মিথ্যা নয়? শৈলেশের জবাব, ‘‘আগের থেকে কিছুটা বেশি আসন যে কংগ্রেস পাবে, সেটা আমাদের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষাই বলছে। কিন্তু সরকার গড়ার ধারে-কাছে নেই তারা। আমরা গত ন’বছরে যে সব প্রকল্প মানুষকে দিয়েছি, তার পরে আর নতুন কিছু ওদের দেওয়ার নেই।’’ ২০১৮ সালের বিধানসভার আগে সাড়া ফেলেছিল কে সি আর-এর আনা রায়তুবন্ধু (কৃষক ভর্তুকি) এবং হিন্দু ও মুসলিম কন্যাদের বিয়ের সময়ে দেওয়া অর্থ (কল্যাণ লক্ষী ও শাদী মুবারক) যোজনা।
কিন্তু এক কুমির ছানা দেখিয়ে বার বার ভোট জেতা যায় না। তাই এ বার দু’টি নতুন প্রকল্প এনে ময়দানে ঝাঁপিয়েছে বিআরএস। শৈলেশ বলছেন, ‘‘দলিতবন্ধু যোজনার টাকায় কী উপায়ে ছোট উদ্যোগ গড়ে তোলা যায়, তার পথ দেখানো হচ্ছে। এই হায়দরাবাদেই দেখবেন অনেক দলিত ওই টাকা কাজে লাগিয়ে বাড়ির পোষ্যদের সহায়তার মোবাইল ভ্যান (পেট গ্রুমিং ভ্যান) নিয়ে রোজগার করছেন ঘুরে ঘুরে।’’
তেলঙ্গানা ভোটে কংগ্রেসের অন্যতম প্রচার, কে সি আর তলায়-তলায় হাত মিলিয়েছেন মোদীর সঙ্গে। কংগ্রেসকে রোখাই তাঁদের লক্ষ্য। এ কারণে আবগারি দুর্নীতিতে দিল্লির মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হলেও কে সি আর-কন্যা কবিতাকে ছেড়ে রাখা হয়েছে। কে টি আর বাহিনীর যুক্তি, রাহুল গান্ধী, সনিয়া গান্ধী, অরবিন্দ কেজরীওয়াল, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতাদেরই বা জেলে ঢোকানো হচ্ছে কোথায়? তা হলে কি ধরে নিতে হবে যে, সেখানেও বিজেপি-র সঙ্গে সেটিং রয়েছে? বিআরএসের দ্বিতীয় যুক্তি, একমাত্র নোট বাতিল বাদ দিয়ে সরকারের আনা সমস্ত বিতর্কিত আইনগুলির সংসদে বিরোধিতা করেছে বিআরএস। পরে ফলাফল বুঝতে পেরে নোটবাতিলের সিদ্ধান্তেরও সমালোচনা করা হয়েছে।
তেলঙ্গানা রাজ্য গঠনের আবেগ এখনও ফুরিয়ে যায়নি ভূমিপুত্র-কন্যাদের, দাবি বিআরএস-এর। বরং তাকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছাই রাজ্যবাসীর মধ্যে প্রবল। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেস অথবা বিজেপি এলে তেলঙ্গানা যে দিল্লির হাইকমান্ডের মতানুসারে চলবে, সেই আশঙ্কাকেও খুঁচিয়ে দিচ্ছে বিআরএস। দলের যুক্তি, একমাত্র কে সি আর-ই তেলঙ্গানার বাইরে কিছু তোয়াক্কা করেন না। কে টি আর-ও সারা বিশ্বে তেলঙ্গানাকে বাস্তবায়িত করতে যাঁরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের নিয়ে এসেছেন হায়দরাবাদে। শুধুমাত্র প্রচলিত আমলাতন্ত্রের উপর ভরসা করছেন না। বরং বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিল্প, পরিকাঠামোর মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির মাথায় বসিয়েছেন প্রশিক্ষিত পেশাদারদের। এমনও অনেকে রয়েছেন, যাঁরা গোটা বছর আমেরিকায় পড়ে রয়েছেন রাজ্যে বিনিয়োগ টানার জন্য।
কোন্ডাপুরের হাইটেক সিটিতে প্রায় আড়াই দশক বসবাস সফটওয়্যার পেশাদার বঙ্গ দম্পতি শ্রুতকীর্তি দত্ত এবং সর্বজিৎ সেনের। তাঁদের মতে, ‘‘গত কয়েক বছরে বহুজাতিক সংস্থার এতই বিনিয়োগ হয়েছে এই রাজ্যে যে, কে সি আর বুক বাজিয়ে আজ খয়রাতিটা করে যেতে পারছেন।’’ কোন্ডাপুরের এই হাই টেক অঞ্চল বাঙালি অধ্যুষিত। গোটা ছয়েক দুর্গাপুজোই তার প্রমাণ। এখানকার পেশাদার বঙ্গ সমাজ মোটের উপর খুশিই, জানাচ্ছেন সর্বজিৎ।
তবে সমাজের উপরের তলার সাদা কলারের কাজ করা মানুষেরা কবেই বা কোনও ভোটে নির্ণায়ক হয়েছেন? মাটির কাছে থাকা, ধুলোবালি মাখা তেলুগু মনই এই যুদ্ধজয়ের আসল চাবিকাঠি। আর ঠিক সেখানেই ‘বঞ্চনা’র সাঁকো নাড়াচ্ছেন রাহুল গান্ধী, প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরা, রেবন্ত রেড্ডিরা। যাঁরা এখনও দলিতবন্ধুর টাকা পেলেন না, অথবা দু’কামরার বাড়ি, তাঁদের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন কংগ্রেস নেতারা। চেষ্টা করছেনতেলঙ্গানা আবেগে চিড় ধরাতেও।
পাখির কাকলিতে ভরা ওয়ার রুম নিশ্চিন্ত, এই আবেগের ভাগ হবে না!