নয়াদিল্লি, ২৬ ডিসেম্বর: বিচারপতিরাই বিচারপতিদের নিয়োগ করবেন, এই ব্যবস্থা বদলানোর আবার দাবি উঠছে বলে সংসদে যুক্তি দিয়েছিলেন মোদী সরকারের আইনমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু। বিজেপি সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইন প্রতিমন্ত্রী পি পি চৌধুরীর দাবি ছিল, সরকার কলেজিয়াম ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করুক।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও শাসক দলের সাংসদের এই মন্তব্যের দু’সপ্তাহ পরে আজ প্রধান বিচারপতি এম ভি রমণা যুক্তি দিলেন, বিচারপতিরা বিচারপতিদের নিয়োগ করছেন, এটা নিছক বহুল প্রচারিত ‘মিথ’ বা অতিকথন। এ কথা বললে কিছু অংশের সুবিধা হয়। সরাসরি কারও নাম না করলেও প্রধান বিচারপতি বলেন, “যাঁরা সবই জানেন, বোঝেন, তাঁরাও এই মিথ প্রচার করেন।” তাঁর যুক্তি, সুপ্রিম কোর্ট ও হাই কোর্টের নিয়োগের প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রের আইন মন্ত্রক, রাজ্য সরকার, রাজ্যপাল, গোয়েন্দা বাহিনী এবং সর্বোপরি, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা থাকে।
আজ বিজয়ওয়াড়ায় প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্যের পরে রাজনৈতিক শিবির থেকে আইনজীবী মহলে প্রশ্ন উঠেছে, কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে কি বিচার বিভাগের নতুন করে ঠান্ডা লড়াই শুরু হচ্ছে?
এই প্রশ্ন ওঠার কারণ, প্রধান বিচারপতি শুধু বিচারপতি নিয়োগের বর্তমান ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করেই থামেননি, সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কেও মন্তব্য করেছেন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের জনসমর্থন যা-ইচ্ছে-তাই কাজ করার পক্ষে যুক্তি হতে পারে না। সংসদে বা বিধানসভায় আইন পাশের আগে যথেষ্ট পর্যালোচনা হওয়া দরকার। বিল পাশের আগে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে তা আলোচনার জন্য পাঠানো হচ্ছে না বলে এত দিন বিরোধী শিবির মোদী সরকারের সমালোচনা করছিল। আজ প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘‘এই কমিটি ব্যবস্থাকে পুরোপুরি কাজে না লাগিয়ে, যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে আইন পাশের ফলে আদালতে মামলার পাহাড় জমতে থাকে।’’
গত এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, বিচারপতি হিসাবে নিয়োগের জন্য কলেজিয়াম কারও নাম সুপারিশ করলে কেন্দ্রীয় সরকারকে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু আইনমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু সম্প্রতি সংসদে যুক্তি দেন, এই ধরনের সময়সীমা বেঁধে দেওয়াটা সঠিক নয়। আজ প্রধান বিচারপতি সরাসরি এই বিষয়টির উল্লেখ না করলেও বলেছেন, “দেখা যাচ্ছে আদালতের নির্দেশ অমান্য করা, এমনকি অসম্মান করারও প্রবণতা বাড়ছে।” আদালত নিজের গণ্ডি পেরিয়ে সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ উড়িয়ে প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, “সরকারের যে কোনও পদক্ষেপ সংবিধান মেনে হওয়া দরকার। সংবিধান তিনটি সমান ক্ষমতার অঙ্গ তৈরি করেছে। সংসদ বা বিধানসভা, সরকার ও বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগকে অন্য দু’টি অঙ্গের পদক্ষেপের আইনি পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগের সেই ক্ষমতা না থাকলে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে হবে।’’
আইনজীবী মহল মনে করছে, মোদী সরকার নতুন করে বিচারপতি নিয়োগে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করলে সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগের সংঘাত আরও বাড়বে। ২০১৪-তে মোদী সরকারই জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন বা ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন আইন তৈরি করেছিল। কিন্তু ২০১৫-তে সুপ্রিম কোর্ট সেই আইন অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেয়। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে বিচারপতিদের বেতন-পেনশন সংক্রান্ত আইনের সংশোধনী বিলে শাসক থেকে বিরোধী শিবিরের অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন, বিচারপতিরাই বিচারপতিদের নিয়োগ করবেন, এই ব্যবস্থা সংবিধান বিরোধী। বিচারপতি নিয়োগে সরকার ও সংসদের ভূমিকা থাকা উচিত। আইনমন্ত্রী এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট না করলেও মন্তব্য করেছিলেন, জাতীয় বিচারপতি নিয়োগ কমিশন বিল নতুন করে সংসদে নিয়ে আসার পক্ষে অনেকেই সওয়াল করছেন। সংবাদমাধ্যম, অসরকারি সংগঠন থেকে আইনজ্ঞেরাও এই দাবি তুলেছেন বলে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন।
প্রধান বিচারপতি আজ কার্যত আইনমন্ত্রীর যুক্তিই খারিজ করে দিলেন বলে আইনজীবীরা মনে করছেন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, তিনি বিচার বিভাগে কোনও শূন্য পদ দেখতে চান না। দেশের ২৫টি হাই কোর্টে এখনও ৪০০-র বেশি বিচারপতির পদ খালি রয়েছে। আটটি হাই কোর্টে কোনও স্থায়ী প্রধান বিচারপতি নেই। আইনমন্ত্রী বিচারপতি নিয়োগের সিদ্ধান্তে সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার বিরুদ্ধে সওয়াল করলেও প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, “সরকার সুপ্রিম কোর্টের
বেঁধে দেওয়া সময়সীমা মেনে চলবে, এটাই প্রত্যাশিত।”