গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পূর্ব-লাদাখের ভারতীয় ভূখণ্ডে চিনা সেনার অনুপ্রবেশের ঘটনা যে ভাবে ‘খারিজ’ করেছেন নরেন্দ্র মোদী, তাতে স্তম্ভিত-হতভম্ব দেশের কূটনৈতিক ও সামরিক মহল। যে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী ফায়দার জন্য উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে ইন্ধনের অভিযোগ উঠেছে বারবার, সেই তিনি চিনের মতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে চলতি সঙ্ঘাতের মধ্যেই কী করে এমন মন্তব্য করে বসলেন, তা নিয়ে বিস্মিত রাজনৈতিক মহলও। অস্বস্তি তাঁর সরকারের অন্দরেও। শুরু হয়েছে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা। শনিবার খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতর তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বিবৃতি জারি করেছে।
সর্বদল বৈঠকে শুক্রবারের ওই মন্তব্যে সরাসরি ‘স্থান’ এবং ‘পাত্রের’ নাম করেননি মোদী। বলেছিলেন, ‘‘ওখানে কেউ আমাদের সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে আসেনি। ওখানে আমাদের এলাকায় কেউ ঢুকেও বসে নেই। আমাদের কোনও পোস্ট (সেনা চৌকি) অন্য কারও দখলেও নেই।’’
এর পরই শুরু হয়ে যায় শোরগোল। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসি) পেরিয়ে এসে চিনের এই আগ্রাসী কাণ্ড নিয়ে যখন দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়, তখন দেশের খোদ প্রধানমন্ত্রী কী করে এমন মন্তব্য করে বসলেন, যা কার্যত শত্রুপক্ষের হাতেই অস্ত্র তুলে দিল!
লাদাখের পথে ভারতীয় সেনা। ছবি: পিটিআই।
আরও পড়ুন: সেনার মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন রাহুলের, পাল্টা তোপ অমিত শাহের
প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দিয়েছে—
• চিনা ফৌজ যদি ভারতের এলাকায় না ঢুকে থাকে, তা হলে কেন শহিদ হতে হল ২০ জন ভারতীয় সেনাকে?
• উপগ্রহ চিত্রে স্পষ্ট, গলওয়ান উপত্যকায় ঢুকে এখনও ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি। সোমবার রাতের প্রাণঘাতী সংঘর্ষের দু’দিন পরে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন, ‘‘এলএসি’র এ পারে ভারতীয় এলাকাতেই পুরো ঘটনা ঘটেছে।’’ প্রশ্ন উঠছে, গলওয়ান উপত্যকায় যে ভারতীয় ভূখণ্ড চিন দখল করে বসে রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রের খবর, তাকে কি তবে চিনা এলাকা বলেই মেনে নিচ্ছে মোদী সরকার?
এর পর পরই অনিবার্য ভাবে যে প্রশ্ন উঠে আসছে তা হল—
• পূর্ব লাদাখের কয়েকশো বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ডকে কি চিনের এলাকা বলে স্বীকার করে নেওয়ার এবং ভারতের মানচিত্র পরিবর্তনের পথে হাঁটতে শুরু করার ইঙ্গিত দিল প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য?
প্রাক্তন বিদেশসচিব এবং চিন-আমেরিকাতে নিযুক্ত প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নিরুপমা রাওয়ের ব্যাখ্যা, ‘‘আমার মনে হয়, চিনের সঙ্গে শক্তির ফারাকের কথা ভেবে, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উদ্দেশ্যে, সরকার বাধ্য হয়েই এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের পুনর্গঠন প্রশ্নে চিন আগের চেয়ে অনেক কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। গলওয়ান-সহ এলএসি-তে শান্তি ফেরানোর প্রচেষ্টা শুরুর ক্ষেত্রে সেটিও বিবেচনায় এসেছে।’’ পাশাপাশি টুইটারে তাঁর মন্তব্য, ‘‘প্যাংগং লেক এবং ডেপসামের ক্ষেত্রেও কি একই পথে হাঁটা হবে? সে ক্ষেত্রে কিন্তু এলএসি নিয়ে ভারতের এত দিনের অনড় অবস্থানের বদল ঘটতে দেখব আমরা।’’
নিরুপমা রাওয়ের টুইট।
কূটনীতি মহলের অনেকেই মনে করছেন, তৈরি হতে পারে নতুন ইতিহাস। এবং ভারতীয় ইতিহাসে একটা টার্নিং পয়েন্টের ইঙ্গিত অনেকে দেখতে পাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদীর কথার মধ্যে।
মোদী সরকারের এই অবস্থানকে ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ’ বলেই মনে করছেন নিরুপমা। যদিও তাঁর মনে আশঙ্কা, ম্যাকমাহন লাইন এবং তাওয়াং সম্পর্কে বেজিং তার অবস্থান বদলাবে কি না, তা আদৌ স্পষ্ট নয়।
এই এলাকাতেই ভারতীয় সেনার সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে চিনা বাহিনীর। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
প্রাক্তন সেনাকর্তাদের সূর অবশ্য অনেকটাই চড়া। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল অজয় শুক্লের মন্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রী কি তবে গলওয়ান নদীর উপত্যকা, প্যাগং লেকের ফিঙ্গার এরিয়া ৪ থেকে ৮-কে চিনের এলাকা বলে স্বীকার করে নিলেন! অনুপ্রবেশ যদি না-ই হয়, তবে কেন সেনাস্তরের বৈঠক, কূটনৈতিক স্তরের আলোচনা, সেনা প্রত্যাহারের প্রশ্ন!’’ অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রকাশ মেননের কথায়, ‘‘মোদী বলছেন, কিছুই হয়নি (ভূখণ্ড হারানোর প্রশ্নে)। হায় ঈশ্বর! এ তো হুবহু চিনের কথার প্রতিধ্বনি শুনছি! আমাদের আইনি এবং সাংবিধানিক অবস্থানটা ঠিক কী জানতে চাই। কেউ সাহায্য করুন।’’ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল স্যান্ডি থাপারের আক্ষেপ, ‘‘বিহার রেজিমেন্টের ২০ জন বীর সেনানির বলিদান মুছে ফেলতে ভারত সরকার ঠিক ৪৮ ঘণ্টা সময় নিল!’’ গলওয়ান সংঘর্ষের পরে বুধবার মোদীর ‘‘মারতে মারতে মরে হ্যায়’’ মন্তব্যকে নিশানা করে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল বীরেন্দ্র ধানোয়ার মন্তব্য, ‘‘জানতে চাই, আমাদের সেনারা কোথায় মারতে মারতে মৃত্যবরণ করলেন।’’
মোদীর মন্তব্যের বিরোধিতায় সরব হয়েছে বিরোধীরাও। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম এ দিন প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একগুচ্ছ টুইট করেছেন। তাঁর প্রশ্ন, চিনের তরফে অনুপ্রবেশ না হলে, কেন ৫-৬ মে থেকে লাদাখের বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হল? কেন ৬ জুন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পর্যায়ের বৈঠক, সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত, সংঘর্ষ এবং ২০ সেনার মৃত্যু? কেনই বা বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মুখে এলএসি-তে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রসঙ্গ। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘কেনই বা এখনও মেজর জেনারেল স্তরের আলোচনা জারি রয়েছে?’’
পি চিদম্বরমের টুইট।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যকে হাতিয়ার করে ফেলেছে চিনও। চিনা সরকারের মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদক টুইটারে লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর “বিবৃতিই পরিষ্কার করে দিচ্ছে যে (সংঘর্ষের) ঘটনাবলী ঘটেছিল চিনের মাটিতেই।” মোদীর মন্তব্যকে অস্ত্র করে চিনের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ন শুক্রবারই বলেছিলেন, ‘‘আমরা তো বরাবরই বলছি, গলওয়ান উপত্যকার অবস্থান এলএসি-র পশ্চিমে। ওটা চিনেরই এলাকা।’’ যদিও বীরেন্দ্র ধানোয়ার মতো প্রাক্তন ভারতীয় সেনাকর্তা জানাচ্ছেন, ১৯৬২ সালের যুদ্ধে আকসাই চিন এলাকা পিপলস লিবারেশন আর্মির দখলে গেলেও, গলওয়ান ভারতেরই ছিল।
এ দিন পিআইবি প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর দফতরের বিবৃতিতে অবশ্য অভিযোগ, “গতকালের সর্বদল বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের অনিষ্টকর ব্যাখ্যা উপস্থাপনের চেষ্টা শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, এলএসি লঙ্ঘনের চেষ্টা হলে সমুচিত জবাব দেবে ভারত। অতীতে এমন ঘটনা উপক্ষা করা হলেও এখন আর তা হবে না।” ১৫ জুন রাতের সংঘর্ষ সম্পর্কে পিআইবি প্রকাশিত বিবৃতির ব্যাখ্যা, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর ভারতের দিকে চীনা সেনারা ঢুকতে পারেনি, তার কারণ আমাদের সশস্ত্র বাহিনী সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিলেন। ভারতীয় ভূখন্ডে চীনা বাহিনীর কাঠামো তৈরির চেষ্টাকে ১৬ নম্বর বিহার রেজিমেন্টের সৈন্যরা বাধা দেয়, তার ফলে উদ্ভুত ঘটনায় তারা প্রাণ বিসর্জন দেন।’’ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল, ‘‘যারা সীমানা পেরিয়ে আমাদের দেশে ঢোকার চেষ্টা করছিল, আমাদের দেশের সাহসী সন্তানরা তাদের বিরুদ্ধে যোগ্য জবাব দিয়েছে’। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অটুট মনোবলের জন্যই এটি সম্ভব হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: দক্ষিণ চিন সাগরে জাহাজ থেকে রহস্যজনক ভাবে উধাও বাঁশদ্রোণীর বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার
সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী। ছবি: পিটিআই।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “সর্বদল বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়েছেন, ১৬ বিহার রেজিমেন্টের বীর সেনানিদের প্রতিরোধের কারণেই চিনের এলএসি লঙ্ঘন এবং নির্মাণ গড়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ওই তারিখের ভিত্তিতেই প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেছেন।” সেই সঙ্গে মানচিত্র পরিবর্তনের অভিযোগ খারিজ করে বলা হয়েছে, “ভারতীয় ভূখণ্ডের মানচিত্র ভারতের কাছে স্পষ্ট। সরকার তা সর্বোত ভাবে মেনে চলতে বদ্ধপরিকর।” প্রধানমন্ত্রীর দফতরের ওই বিবৃতিতে রাজনীতির ছোঁয়াও রয়েছে। বলা হয়েছে, ‘‘গত ৬০ বছরে ৪৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা কিভাবে হাত ছাড়া হয়েছে দেশ সে বিষয়ে অবগত রয়েছে। সর্বদলীয় বৈঠকে বিস্তারিতভাবে জানানো হয় কোন কোন জায়গা অবৈধভাবে দখল হয়ে গিয়েছে।’’
আমেরিকার নিউ ইয়র্ক টাইমসে এ দিন প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মে ও জুন মাসে এলএসি পেরিয়ে এসে পূর্ব-লাদাখের অন্তত ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা চিন দখল করেছে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলএসি বরাবর ভারত দারবুক-শিয়োক-দৌলত বেগ ওল্ডি সড়ক নির্মাণ করায় ওই অঞ্চলে দ্বিপাক্ষিক সামরিক অসাম্য অনেকটাই কমে এসেছে। আর তাই চিনের এই বেপরোয়া পদক্ষেপ।
এমনকি, বেজিংয়ের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকার করা না-হলেও ‘শক্তিশালী’ নেতা হিসেবে মোদীর ভাবমূর্তি করতেই তাঁর দল (বিজেপি) সংঘর্ষে ৪৩ জন চিনা সেনার মৃত্যুর খবর প্রচারে আনছে বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনের দাবি। এসেছে ২০১৪ সালে ‘মোদীর শহর’ আমদাবাদে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং নানা মঞ্চে বারবার আলোচনার প্রসঙ্গও।