জো বাইডেনকে অভিনন্দন নরেন্দ্র মোদীর।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ব্যক্তিগত রসায়ন’ বহুচর্চিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত চার বছর আমেরিকার ভারত-নীতির প্রশ্নে অহরহ ট্রাম্পের ‘খামখেয়ালিপনা’ এবং ‘অপ্রত্যাশিত’ মন্তব্যে জেরবার এবং নাজেহাল হয়েছে নয়াদিল্লি। এ বারে তার থেকে অন্তত মুক্তি মিলবে। কিছুটা হলেও আলগা হবে ভারতীয়দের ভিসা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বজ্র আঁটুনি।
তবে সেই সঙ্গে মোদী সরকারের বিভিন্ন নীতি, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি (কাশ্মীর থেকে ৩৭০ প্রত্যাহারের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে সাম্প্রদায়িক অশান্তি) এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মোদী সরকারের উপরে ওয়াশিংটনের চাপ বাড়বে আগের জমানার তুলনায় অনেকটাই বেশি। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি নিয়েও কেঁচে গণ্ডূষ করতে হবে। চুম্বকে, জো বাইডেনের হোয়াইট হাউসে আগমনে ভারত এবং আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এগুলিই সম্ভাব্য পরিবর্তন। বাকি কৌশলগত দিকগুলি উনিশ-বিশ একই রকম চলবে বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা।
প্রাক্তন বিদেশসচিব কানওয়াল সিব্বলের কথায়, “অন্য দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে বরাবরই আমেরিকা সরব হয়েছে। বিল ক্লিন্টনের সময়েও আমরা একই ভূমিকায় দেখেছি হোয়াইট হাউসকে। এক মাত্র ট্রাম্প এ সব নিয়ে নিরুত্তাপ ছিলেন। তবে তিনি এ সবে নাক না গলালেও তাঁর সরকারের বিদেশ মন্ত্রক কিন্তু সিএএ বা দিল্লির সাম্প্রদায়িক অশান্তির মতো বিষয়গুলি নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছে। এ বার তা নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে।’’:
আরও পডুন: কোভিড নয়, বিপর্যয়ের মূলে নোটবন্দি: রাহুল
তবে এই সঙ্গে সিব্বল মনে করেন, এই মুহূর্তে ঘরে-বাইরে আমেরিকা কিছটা দুর্বলও। ফোঁস করার ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম। তাদের নিজেদের দেশই বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে উত্তাল। পাশাপাশি চিনকে নিয়ে প্রবল চাপের মধ্যে রয়েছে আমেরিকা। সে সবের সঙ্গে রয়েছে কোভিড-আতঙ্ক। ফলে তারা কতটা চাপ বাড়াবে, সেটাও দেখা দরকার।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তান পরিস্থিতি এবং পাকিস্তান নীতি নিয়েও চোখে পড়ার মতো কোনও বদল ঘটবে না আমেরিকার নতুন জমানায়। তালিবানের সঙ্গে শান্তি প্রক্রিয়া এবং আলোচনার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা থেকে পিছিয়ে আসা নতুন সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। সেখানে নতুন করে সেনা পাঠানো তো আরওই অসম্ভব। ইতিমধ্যেই আফগানিস্তান যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আমেরিকার অন্দরে একটা অন্য আবেগ তৈরি হয়েছে। তবে আমেরিকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রণেন সেনের কথায়, ‘আমেরিকার কাবুল নীতির প্রশ্নে ভারতের ভূমিকাকে যে ভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছিল, তার ইতরবিশেষ হবে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে ভারতের মানবিক ভূমিকা এবং অবদানকে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট উভয় দলই স্বীকৃতি দিয়ে থাকে।’
কূটনীতিকদের মতে, ভারতের পক্ষে ভরসার বিষয় হল যে, বাইডেন নয়াদিল্লির কাছে কোনও নতুন চরিত্র নন। যেমনটা ছিলেন ট্রাম্প। গত দশকে দু’দেশের মধ্যে অসামরিক পরমাণু চুক্তির অন্যতম রূপকার ছিলেন জো বাইডেন। সে সময়ে সেনেটর বারাক ওবামা এই চুক্তিকে সমর্থন করার বিষয়ে কিছুটা দ্বিধান্বিত থাকলেও বাইডেন রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট উভয় পক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করেছিলেন আমেরিকান কংগ্রেসের অনুমোদন পাওয়ার জন্য। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীনই আমেরিকান কংগ্রেসে প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে আমেরিকার বিশেষ কৌশলগত মিত্রের স্বীকৃতি পায় ভারত।
বাইডেনের নির্বাচনী ইস্তেহারে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে স্থায়ী এবং আইনের শাসনযুক্ত ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠনের জন্য কাজ করবে তাঁর প্রশাসন। যেখানে চিন-সহ কোনও দেশই তার প্রতিবেশীকে হুমকি দিতে পারবে না। ঘটনা হল, ট্রাম্প প্রশাসনও চিন প্রশ্নে অত্যন্ত সরব হয়ে ভারতের পাশে থেকেছে। সাউথ ব্লক আশা করে, বাইডেনের ক্ষেত্রেও একই ভূমিকায় দেখা যাবে ওয়াশিংটনকে। প্রাক্তন বিদেশসচিব নিরুপমা রাওয়ের কথায়, “চিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার প্রশ্নে ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে কৌশলগত সমন্বয় খুবই শক্তিশালী। বর্তমান সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পাশে যে ভাবে আমেরিকা দাঁড়িয়েছে, তা ভবিষ্যতেও লঘু হবে না। জো বাইডেন সব সময়ই ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু।“
ভারতীয় বণিকসভা সিআইআই-এর পক্ষ থেকে আজ বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়েছে, দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সহযোগিতা ও সমন্বয় এ বার আরও বাড়বে। শক্তিক্ষেত্র থেকে প্রতিরক্ষা, উৎপাদনক্ষেত্র— সর্বত্রই দ্বিপাক্ষিক অগ্রগতি দেখা যাবে বলে আশা করছেন তাঁরা। বাইডেনের নির্বাচনী নথিতে আমেরিকায় বৈধ কাগজপত্র না থাকা প্রায় সওয়া কোটি মানুষকে সে দেশের স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। যার মধ্যে অন্তত পাঁচ লক্ষ ভারতীয়। কিন্তু নির্বাচনী নথিতে মুদ্রিত থাকা এবং বাস্তবে আমেরিকার কংগ্রেসের অনুমোদনে এই সংক্রান্ত বিল পাস করানো যে এক নয়, সেটা সাউথ ব্লক জানে। গত চার বছরে ট্রাম্প সরকার অভিবাসন প্রশ্নে যে নীতি নিয়েছে, তাকে এক কথায় উল্টে দেওয়া এই মুহূর্তে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষে সহজ হবে না। ভারতের তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পে আমেরিকার ভিসা নীতির যে ছায়া পড়েছে, তা দূর হতে সময় লাগবে বলেই মনে করা হচ্ছে। বাণিজ্যচুক্তির ক্ষেত্রেও ডেমোক্র্যাটরা নিজস্ব নীতি নিয়ম যাচাইয়ের মাধ্যমে এগোবেন। আমেরিকার বাজারে ভারতের ওষুধের উপর কর এতটাই বাড়িয়ে রাখা হয়েছে যে, রফতানির প্রশ্নে মার খাচ্ছে এ দেশের ওষুধ সংস্থাগুলি। বাইডেন এ ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেন, সে দিকেও নজর রাখছে সাউথ ব্লক। একই কথা প্রযোজ্য ভারতের অন্যান্য অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে, যা আগে আমেরিকার বাজারে বিশেষ কর ছাড়ের সুবিধা পেত।
বাংলাদেশে ভারতের প্রাক্তন হাইকমিশনার এবং কূটনীতিবিদ দেব মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সৌহার্দ্য ছিল ঠিকই। কিন্তু তার জন্য দেশের কতটা উপকার হয়েছে সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ নই। ট্রাম্প, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি ভঙ্গ করায় ভারতের জন্য তা সার্বিকভবে ক্ষতিকর হয়েছে। ইরান মস্কো বেজিং অক্ষ তৈরি হয়েছে।’’ তাঁর কথায়, ‘ডেমোক্র্যাটরা আসার ফলে অনেকটাই উদার বৈষম্যহীন একটা আমেরিকাকে দেখতে পাওয়া যাবে যা কেবলমাত্র ভারত নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই ভাল।’
কমলা হ্যারিসের ভারতীয় সংযোগের কারণে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে উল্লসিত হওয়ার খুব একটা কারণ নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। কানওয়াল সিব্বলের
কথায়, “প্রথমত উনি ভারতের সঙ্গে খুব একটা একাত্মবোধ করেন, এমন কোনও পরিচয় পাওয়া যায়নি। কমলা প্রকাশ্যেই মোদী সরকারের বিভিন্ন নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন এর আগে। ৩৭০ প্রত্যাহার থেকে সিএএ- তাঁর কড়া সমালোচনা শোনা গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিদেশনীতি সম্পর্কে কমলার আদৌ কোনও ধারণা নেই। বাইডেন যাতে সিদ্ধহস্ত। ফলে অদূর ভবিষ্যতেই আমেরিকার বিদেশনীতির বিষয়টিতে কমলার হস্তক্ষেপ ক্রমশ কমবে বলেই
আমার ধারণা।’’