মানুষগুলো কখনও হরিজন, কখনও বহুজন হয়েই থেকে যান। শুধু 'জন' হয়ে উঠতে পারেন না। ছবি: পিটিআই।
‘অচ্ছে দিন’-এর ভারতবর্ষে ন্যায়ালয়ের ন্যায় থেকে রাজকোষের ব্যয়— কোনও কিছুই গোদা বুদ্ধিতে আর ধরা পড়ছে না। তবে মগজে খুব শান দিয়ে একটি বিষয়ে মাঝে মাঝে সামান্য স্বচ্ছতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তা হল, সমাজের প্রান্তিক এবং দুর্বল মানুষগুলোর স্বাভাবিক পাটিগণিতের নিয়মেই আরও একটু নিঃস্ব হয়ে পড়া, বেশি হারে চূড়ান্ত অন্যায়ের শিকার হওয়া এবং উপসংহারে ভারতের মূল নাগরিক স্রোতের থেকে আর একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। স্বাধীনতার পঁচাত্তর পূর্তির থেকে মাত্র বছর দুয়েক আগে দাঁড়িয়ে একটি সাম্প্রতিক এবং বিতর্কিত হিন্দি ছবির সংলাপ ধার করে বলা যায়— আমাদের বহুদলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এতগুলো দলের প্রাণপাত পরিশ্রম সত্ত্বেও, কী ভাবে যেন এই মানুষগুলো কখনও হরিজন, কখনও বহুজন হয়েই থেকে যান। শুধু 'জন' হয়ে উঠতে পারেন না, যাতে ভারতের 'জনগণমন'-র মধ্যে এঁদের-ও গোনা চলে। তবে কি পৃথিবীর গরিষ্ঠতম গণতন্ত্রের গোড়াতেই কোনও গলদ থেকে গিয়েছিল? তাই কি পঁচাত্তর বছরের প্রাক্কালে পৌঁছেও সেই গণতন্ত্র সাবালক হতে পারল না, আশ্রয় জোগাতে পারল না তার বৃহত্তর অংশকে? ভারতীয় আর্থসমাজের বিরাট ব্যাপ্তি ও বিভিন্নতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নের উত্তর অস্পষ্ট।
আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে গেলে— এখনকার শাসকদলের যে স্বপ্নের রামরাজত্ত্ব, তার কাছাকাছি সময়েই ভারতে বিকশিত হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদ, তর্কসাপেক্ষে যা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো বর্ণবাদী দর্শন। পরবর্তীতে এই দর্শনের কাঠামোটা দৃঢ় হয়েছিল মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা নামক গ্রন্থটির মধ্যে, যার অনুশাসনে একসময় নিয়ন্ত্রিত হতো বৈদিক সমাজ। আজকের ভারতে বেশ কিছু পরিসরে এই বইটির নাম আবার নতুন করে শোনা যাচ্ছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে। বর্ণবাদ ব্যাপারটা খুব সরল করে বললে— পৃথিবী জুড়ে নবজাগরণ বা রেনেসাঁর সময় বিকশিত যে মানবতার দাবি— তার একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে সমাজ চালনার অভিমুখ।
এই দর্শনে শুধু মানুষ হয়ে জন্মানোটাই সমাজের স্বাভাবিক সুযোগসুবিধে পাওয়া কিংবা ন্যায়বিচারে অংশগ্রহণের অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারে না। তার জন্যে জন্মাতে হবে উচ্চবর্ণের পরিবারে, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় বা অন্তত বৈশ্যের ঘরে। কিন্তু যে জন্মের উপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই, তার কীর্তিতেই নামের পিছনে ঠেকে থাকে বংশ-পরিচয় বা পদবি। পরিসংখ্যানের নিয়মে বেশির ভাগ সময়েই সেই পরিচিতি মানুষকে উচ্চবর্ণে অন্তর্ভুক্ত করে না। তখন তাঁর দুপেয়ে পরিচয়ের চেয়ে অনেক বড় হয়ে ওঠে অস্পৃশ্য সীলমোহর, বর্ণবাদের নিরিখে। আশ্চর্য শুনতে লাগলেও, ব্রাহ্মণ্যবাদ কিন্তু সেই প্রাচীন ভারতেই ডারউইন সাহেবের আবিষ্কৃত অত্যাধুনিক জঙ্গলের নিয়মটিকে বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হয়েছিল, যে নিয়মের নাম যোগ্যতমের উদ্বর্তন (Survival of the Fittest)। তফাৎ এইটুকুই যে, সেখানে ডারউইনের বদলে তত্ত্বকার এক অদৃষ্ট বিশ্বস্রষ্টা, নাম যাঁর ব্রহ্মা। বিষয়টা অনেকটা এ রকম যে পয়সা ও ক্ষমতার জোরে সমাজে যারা মানুষের মতো বেঁচে থাকার যোগ্য, সেই ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণেরা নিজেদের বংশানুক্রমিক দাস বানিয়ে রাখবে সমাজের একটা বড় অংশকে। সময়ের সাথে সামাজিক নিষ্পেষণের যন্ত্রটাকে আরও মজবুত করতে উচ্চবর্ণের সংজ্ঞায় শূদ্রদের থেকেও নিকৃষ্ট এবং বর্ণবহির্ভূত অন্ত্যজ তথা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হল। এঁরা রইলেন মূল চার বর্ণের বাইরে। একই ভাবে লিঙ্গভেদে বৈদিক চতুর্বর্ণের বাইরে গজিয়ে উঠল আরও দুই অংশ— নারী ও পুরুষ। সেখানেও ক্ষমতাশালী অংশের চোখে যোগ্যতমদের সুবিধের জন্যে অর্ধেক আকাশের ভাগে অর্ধচন্দ্র।
তবে অনেকে শ্রীমদ্ভগবতগীতাকে শুধুমাত্র একটা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ফুল-বেলপাতা দিয়ে ঠাকুরঘরে সাজিয়ে রাখেন না, পড়েনও। তাঁরা দেখে থাকবেন, গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ১৩ নম্বর শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ বলছেন— "চতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ"। এই শ্লোকটির সরল অর্থ হল, বর্ণভেদ সৃষ্টি করেছেন সেই ঈশ্বরাত্মা কথক, কিন্তু মানুষের ক্ষমতা বা গুণ কিংবা উপযুক্ত বৃত্তি বা কর্ম মেনে কখনওই তার নামের পরে কী পদবি বসবে সেই অনুসারে নয়। তা হলে তো ব্যাপারটা খুব জটিল রইল না। অনেকটা এখনকার প্রস্তাবিত বৃত্তিমূলক শিক্ষার মতোই, যাঁর যেমন যোগ্যতা সেইরকম পেশা তিনি বেছে নেবেন এবং সেখান থেকেই নির্ণীত হবে তাঁর বর্ণ। অর্থাৎ তখনকার দিনে দেবভাষার চর্চা যাঁদের দখলে ছিল, তেমনই কিছু বর্ণশ্রেষ্ঠের দল সমাজের ধনী ও ক্ষমতাবান অংশের ইশারায় আরও অনেক শ্লোক জুড়ে দিলেন বিভিন্ন সংহিতায়। সেই সব শ্লোকের ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে গেল বহু মানুষের নিজস্ব বৃত্তি বেছে নেওয়ার অধিকার, হারিয়ে গেল নিচু জাতের ন্যূনতম সামাজিক সম্মান নিয়ে বাঁচার স্বপ্ন। আমাদের সামাজিক ইতিহাস বারবার দেখিয়ে দিয়েছে যে অস্পৃশ্যতা আসলে এক জন্মদোষ, এর দায় বৃত্তিগত নয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, আলাদা আলাদা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে এই বর্ণভেদ, মিশে রয়েছে একেবারে শরীরের সাথে চামড়ার মতো। চামড়ার রঙের মতোই শুধু প্রকাশভঙ্গিতে কিছু বিভিন্নতা ছাড়া বাকিটুকু এক। তাই হাথরাস হাতড়িয়ে আরও একটি উদাহরণ মেলে এ দেশের সামাজিক সংজ্ঞার। শুকনো পরিসংখ্যান বদলায় দেশের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্টে। বিশেষ বিশেষ রাজ্যের পরিসংখ্যান আবার কেন্দ্র পর্যন্ত সময় মতো পৌঁছতেই পারে না।
এখানে লক্ষ্য করার মত বিষয় হল, নিম্নবর্ণ বা দলিতেরা সংখ্যার দিক থেকে সমাজের নেহাত একটা নগণ্য অংশ কিন্তু নন। তা হলে একটা চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থায়, কেবল দলিতজন্মের অভিশাপে যখন সমস্ত অধিকার চলে যায়, তাঁরাই বা সেটা সহ্য করেন কেন? অবশ্যই কিছুটা এই কারণে যে যুগ-যুগ ধরে ধর্মের মোড়কে এঁদের ডিএনএ-র মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে– বংশপরম্পরায় শ্রম দিয়ে হোক কি শরীর দিয়ে উচ্চবর্ণের ভোগে লাগাটাই নিয়তি এবং সেটাই ভগবানের নির্দেশ। একবার ভেবে দেখা যেতে পারে বাবাসাহেব অম্বেডকর বা জ্যোতিরাও ফুলে-র মতো কিছু ব্যতিক্রমী মানুষের প্রচেষ্টাকে বাদ দিলে, ভারতে সাঁওতাল বা কোল বিদ্রোহের মতো কোনও দলিত বিদ্রোহ কি কখনও একই মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল? আসলে আদিবাসী সমাজে সম্ভবত ধর্মগ্রন্থের নির্দেশ-ভিত্তিক বর্ণভেদ প্রকট ছিল না। ফলে কোল, ভীল, মুন্ডাদের কাছে, সরাসরি ইংরেজদের মদতে ধনী জোতদার ও জমিদারদের দ্বারা অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ার মধ্যে যে অন্যায়, তা ছিল দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। সেখানে কখনও শহুরে দিকু বা বাবুশ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তারা এক কাল্পনিক ঈশ্বরকে রাগিয়ে দেবে, এমন বংশানুক্রমিক ভীতি ও ভুল ধারণার বিশেষ জায়গা ছিল না। ইংরেজ আমলে মিশনারি স্কুলগুলোর সহায়তায় আদিবাসীদের মধ্যে পরম শান্তিময় প্রভু জিশুর বাণী ছড়িয়ে এই সব ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা হলেও সেগুলো তেমন সফল হয়নি। কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে অরণ্যচারী নন, এমন যে সব অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য ও প্রান্তিক মানুষকে বুঝিয়ে আসা হয়েছে যে উচ্চবর্ণের লোকেরা এঁদের ওপর জুলুম করবেন এটাই স্বাভাবিক। বোঝানো হয়েছে যে ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয়দের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ মানেই তা ঈশ্বরের দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরার সামিল। সমাজবিজ্ঞান অতটা সরল নয়, তবে এটা একটা কারণ হতেই পারে যার জন্যে অন্ত্যজদের পক্ষে ব্যাপক গণবিদ্রোহ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বর্ণবাদ এই ভাবে সমাজের একটা অংশকে শুধু ব্যাপক ক্ষমতাই পাইয়ে দেয়নি, বরং তার বিপরীত অংশের মানুষগুলোর তীব্র প্রতিবাদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রটাও শেষ করে দিয়েছে। অন্যদিকে, বর্ণবাদী দর্শনের দাপট পৌঁছতে পারেনি বলেই হয়তো আদিবাসী সমাজের মানুষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভাবে একেবারে নিঃস্ব হয়েও কোনও ঈশ্বরের অপ্রসন্নতার তোয়াক্কা করেননি। বরং কিছু ক্ষেত্রে ইংরেজ কিংবা দিকু-দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিবাদের সাহস পেয়েছিলেন।
মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, স্বাধীনতা-উত্তর ভারত ষাটের দশকের শেষে যে বিদ্রোহের ঢেউতে উত্তাল হয়ে উঠল, সেই নকশালবাড়ি আন্দোলনও আদতে ছিল বড়লোক ও মধ্যস্বত্বভোগী জোতদার, জমিদারদের বিরুদ্ধে ভূমিহীন কৃষক আর মজুরদের সংগ্রাম। সেখানে কিন্তু উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, ঠাকুরদের বিরুদ্ধে পুরুষানুক্রমে শোষিত হয়ে আসা দলিত-অস্পৃশ্য মানুষগুলোর সংঘবদ্ধ কোনও লড়াই স্থান পায়নি। নকশালবাড়ি ইতিহাসের ধূসর পাতায় মিলিয়ে যাবার প্রায় দুই-দশক পরে, ভারতের অন্তত একটি রাজ্য বিহারে আরজেডি সুপ্রিমো লালু প্রসাদ যাদবের চেষ্টায় দলিত এবং পিছড়ে বর্গের বহু মানুষ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় প্রক্রিয়াটিতে সদর্পে যোগদান করতে পেরেছিলেন। ছাপ মেরেছিলেন ব্যালট পেপারে। সেই নব্বইয়ের দশকে দলিতদের ব্যাপক ভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া এবং অনেকাংশে ক্ষমতা দখল স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে হলেও বেশ উল্লেখযোগ্য। ভারতবর্ষের অপরিণত রাজনীতির প্রেক্ষিতে বিষয়টা আংশিক সামাজিক আন্দোলনের মতোই ছিল। পরবর্তী কালে তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপ-সহ গাদা গাদা অভিযোগ জমা হতে থাকলেও, লালুই পেরেছিলেন, প্রায় নিঃশব্দে, অতিপ্রান্তিক মানুষগুলোকেও গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের ন্যূনতম ধাপটিতে যুক্ত করতে, এঁদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বাভিমান জাগিয়ে তুলতে।
পঁচাত্তর বছরের প্রাক্কালে পৌঁছেও গণতন্ত্র সাবালক হতে পারল না, আশ্রয় জোগাতে পারল না তার বৃহত্তর অংশকে।
কিন্তু প্রত্যেক ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া ঘটতে বাধ্য। নিউটনের তৃতীয় সূত্রে তা সমান হলেও, রাজনীতিতে তা কিন্তু অনেকটা এদিক ওদিক হয়ে যায়। নব্বই-এর দশকের গোড়াতে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের নেতৃত্বে ভারত সরকার নিম্নবর্গীয়দের (ওবিসি) সংরক্ষণের জন্য মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলো কার্যকরী করতে উদ্যোগী হয়। এতদিন পায়ের তলায় দাবিয়ে রাখা নিচু জাতের মানুষগুলোই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, কাজের টেবিলে পাশে বসতে পারে এই আশংকায় ভয়ানক অভিঘাত তৈরি হয় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে। সেই ক্ষোভের হাত ধরেই প্রায় রকেটের গতিতে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে উঠে আসে বিজেপি। উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ক্ষোভের পাশাপাশি মারাত্মক মুসলমান বিরোধিতার রাস্তাতেও হেঁটে হিন্দুদের একত্রিত করার চেষ্টা সফল হয়। সেই রাস্তাতেই তার পর গড়িয়ে চলে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথের চাকা। নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত জুড়ে যে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, তার পিছনে অবশ্যই একটা বড় শক্তি উচ্চবর্ণের মানুষদের ঐক্য। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের রাজ্যের দিকে তাকালেও খুব সহজে বোঝা যায় যে— দলের নাম যাই হোক না কেন, শাসন সেই উচ্চবর্ণের।
জঙ্গলের নিয়মেই সমাজের দুর্বলতর অংশ— সে দলিতই হোক কি নারী— বিপর্যস্ত হতেই থাকে কখনও জাতপাতের নামে, কখনও সম্মানরক্ষার স্বার্থে খুন হয়ে কিংবা কখনও নিছকই পারিবারিক বিবাদের বদলা নিতে অতিভেদ্য চাঁদমারি হয়ে গিয়ে। ডান, বাম সব সরকারের রাজ্যেই মোটামুটি কমবেশি ঘটে চলে এই ধরনের অপরাধ। একদিকে সমাজের ভগবানেরা সশরীরে বা ছাই হয়ে ডুবতে থাকেন সরযূ, গঙ্গা, গোদাবরীতে। আর অন্ত্যজ শিশু, মহিলা, বা যুবকদের অপমানিত, পিঠের শিরদাঁড়া ভাঙা, জিভ-ছেঁড়া লাশ গড়াতে থাকে বাজরার ক্ষেতে। সরকার বা প্রশাসনে আসীন থাকেন যাঁরা, তাঁরা সাধারণ ভাবে এই কালমৃগয়ার শরিক নন। কিন্তু তাঁদের পোষ্য সমর্থকরা যখন প্রান্তিক মানুষের রক্ত মেখে ফেলেন দুই হাতে? তখন জমে ওঠে মুখ বাঁচানোর প্রতিযোগিতা, তখন টেনে আনা হয় বিরোধী দলের গোলমাল পাকানোর বস্তাপচা তত্ব, তখন নির্ণীত হয় প্রতিবাদের পিছনে ধান্দাবাজির পরিমাণ। প্রতিবাদীর দুর্বলতাকে লক্ষ্য করে অসার প্রশ্নমালা দ্রুত বৈধতা পেয়ে যায়, কারণ লুকোনোর মতো লাশ জমে উঠেছে সব দলেরই আস্তিনের তলায়। মূল সমস্যা হল ভারতীয় গণতন্ত্রের বুনিয়াদটি এখনও অপরিণত। তার ফলে, উত্তর ভারতের একেবারে সাম্প্রতিকতম ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, একটা অতি দুঃখজনক মৃত্যুর পরেও কী ভাবে রাজনীতির জল ঘোলা করা যায়। যখন একটি নির্বাচিত সরকারের হাতের বাইরে চলে যায় পরিস্থিতি, তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আকুল চেষ্টায় অদ্ভুত ভাবে খাড়া করতে হয় অলীক বহিরাগতের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, কিংবা লোকদেখানো নির্বাসনে পাঠাতে হয় সরকারি আধিকারিকদের। এই সব যুক্তি-তক্কো-গল্পের কিছুটা থিতিয়ে আসার মধ্যেই আবার একটা অধিকারহীন মানুষের ঝরে যাওয়ার খবরে উত্তাল হবে হয়ত জাতীয় মিডিয়া। তখন হয়তো এই লেখাটাই আবার প্রকাশ করতে চাইব ন্যূনতম পরিবর্তনযোগে। মাঝের সময়টুকুতে শহুরে সুবিধেবাদী জীবনের গায়ে ঠেস দিয়ে আয়নাতে সিঁথি সামলাবো আমরা। তাই ‘সকলের উন্নতি, সকলের বিকাশ’-এর বদলে ডারউইন সাহেবের ঢঙে, শুধু ক্ষমতাবানের উদ্বর্তন-ই আমাদের জগতের আসল নিয়ম।
সবশেষে যে প্রশ্নটি মনে উঁকি দেয়, তা হল এই নৃশংসতার কারণ সামাজিক নাকি রাজনৈতিক? কথাটি এই বলে এড়িয়ে যাওয়া সহজ যে রাজনীতি আজকের সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই এই আলোচনা অর্থহীন। আদতে ঘটনা তা নয়। সমাজের থেকে রাজনীতির জোর আজকের ভারতে বেশি। অবশ্যই সমাজের মাথার দিকের মানুষ অনেক বেশি সুযোগ পান নিজের অনৈতিকতা ঢাকার। কিন্তু সঙ্গে এটাও তো সত্যি যে রাজনীতি এবং প্রশাসন তার থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। একটি দল ক্ষমতা পেয়ে যাওয়ার পর তারা যদি আবার গদিতে ফেরার জন্যে নিয়ম ভাঙে, তখনই অনৈতিকতা গেড়ে বসতে বাধ্য। আইনের শাসন কথাটি ন্যায়ালয় থেকে উৎসারিত হতে পারে, কিন্তু তার রূপায়ণের দায়িত্ব সরকার এবং প্রশাসনের। সরকার আর প্রশাসন সামাজিক বিষয় নয়, একেবারেই রাজনৈতিক। তাই হাথরাস থেকে ভাটপাড়া, মৃত্যুর কারণে সমাজের ঘাড়ে দোষ চাপাতে গেলে রাজনীতির অপরিণতির কথাই মানতে হবে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর প্রয়োজন নেই যে এ দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই কমবেশি স্ববিরোধিতায় জর্জরিত। এতদিনের বৃহত্তম গণতন্ত্র যদি প্রাচীন সমাজের হাড়িকাঠে দিনে দুবার মাথা দেয়, আর সেই সমাজকে যদি নিয়ন্ত্রণ করে ধর্ম এবং বর্ণভিত্তিক রাজনীতি, সেক্ষেত্রে সভ্যতার লাশ সময়ের স্রোতে উল্টোদিকেই ভাসে। প্রাচীনকে আঁকড়েই যদি গণতন্ত্র যাপন করতে হয়, সেখানে আধুনিক প্রতিবাদের সবটুকুই বিমূর্ত, এই লেখাটির মতই।
(লেখকেরা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যাক্তিগত)