গুজরাতের বিধানসভা ভোটে নজিরবিহীন খারাপ ফল কংগ্রেসের। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আভাস পাওয়া যাচ্ছিল ভোটের মাস কয়েক আগে থেকেই। সেই আভাসকে আরও শক্তপোক্ত ভিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল সবক’টি বুথ ফেরত সমীক্ষা। সোমবার গুজরাতে দ্বিতীয় তথা শেষ পর্বের বিধানসভা ভোটের পর সবক’টি সমীক্ষাই বিজেপিকে বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে রাখার পাশাপাশি কংগ্রেসের নজিরবিহীন খারাপ ফলের পূর্বাভাস দিয়েছিল। বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ হওয়া শুরু হতেই মিলতে শুরু করল সেই পূর্বাভাস। স্পষ্ট হয়ে গেল, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের রাজ্যের রাজনীতিতে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে রাহুল গান্ধী-মল্লিকার্জুন খড়্গের দল।
ভোটগণনার প্রবণতা বলছে ১৮২ আসনের গুজরাত বিধানসভায় বিজেপির আসন ১৫৮ পৌঁছে যেতে পারে। ভেঙে যাচ্ছে ১৯৮৫-র বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের ১৪৯টি আসনে জেতার রেকর্ড। অন্য দিকে, বিধায়ক সংখ্যা ১৯-এর নীচে নেমে যাওয়ায় মহাত্মা গান্ধী-বল্লভভাই পটেলের রাজ্যে কংগ্রেস বিরোধী দলের মর্যাদাও হারাতে চলেছে। বিজেপি প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে। কংগ্রেসের ঝুলিতে মাত্র ২৭ শতাংশ। দ্বিতীয় বার ভোটে লড়তে নেমেই প্রায় ১৩ শতাংশ ভোট পেতে চলেছে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আপ।
২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে কড়া টক্কর দিয়েছিল কংগ্রেস। ১৮২ আসনের বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ৭৭ জন ‘হাত’ চিহ্নের প্রার্থী। ৯৯টি আসনে জিতে কোনওক্রমে সরকার গড়েছিল বিজেপি। ২০১৭-র বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ওই রাজ্যে ৪৪ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছিল। অন্য দিকে, বিজেপির ভোট ৪৯ শতাংশ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের পরে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটেও মোদী-শাহের রাজ্যে খাতা খুলতে ব্যর্থ হয় সনিয়া-রাহুলের দল। ২৬টি লোকসভাই যায় বিজেপির দখলে। বস্তুত এর পর থেকেই ভাঙন ধরতে শুরু করে কংগ্রেস শিবিরে।
গত ৫ বছরে গুজরাতে কংগ্রেসের ১৯ জন বিধায়ক দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। এই তালিকায় রয়েছেন অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর যুবনেতা অল্পেশ ঠাকোর, প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা তথা একদা কংগ্রেসের ‘জনজাতি মুখ’ মোহনসিংহ রাথওয়ার মতো নেতা। ১০ বারের বিধায়ক মোহনের দলত্যাগ দক্ষিণ ও পূর্ব গুজরাতের আদিবাসী প্রধান অঞ্চলে কংগ্রেসের খারাপ ফলের অন্যতম কারণ বলে দলের একাংশের মত।
২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে রাহুল সামনে থেকে দাঁড়িয়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। জিএসটি, নোটবন্দি, পাটীদার বিক্ষোভ এবং বিভিন্ন এলাকায় বিজেপি নেতাদের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে ‘অস্ত্র’ করেছিলেন হার্দিক পটেল, জিগ্নেশ মেবাণী, অল্পেশ ঠাকোরদের মতো তরুণ-তুর্কিদের। জনজাতি, দলিত, পাটীদার, অনগ্রসর (ওবিসি), মুসলিমদের একই বন্ধনীতে আনার জন্য রাহুল অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন বিজেপির। এ বার দিন কয়েকের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ ছাড়া আগাগোড়ায় গুজরাতের প্রচারপর্বে রাহুল ছিলেন অনুপস্থিত। দেখা যায়নি সনিয়া ও প্রিয়ঙ্কাকেও। জনজাতি এবং দলিত ভোটের উপর তার ‘প্রভাব’ পড়েছে বলে ভোট-পণ্ডিতদের অনেকে মনে করছেন।
তা ছাড়া যে অনগ্রসর এবং দলিত শ্রেণিকে পাশে নিয়ে কংগ্রেস গুজরাতের ভোটে এগোতে চেয়েছিল, তাদের বড় অংশের ভোট ‘হাত’ প্রার্থীরা পাননি বলেই প্রাথমিক বিশ্লেষণে মনে করছে কংগ্রেস। গুজরাতের রাজনীতিকদের একাংশের, এই অনগ্রসর এবং দলিতদের মধ্যে যাঁরা মধ্যবিত্ত, তাঁদের মধ্যে জাতের চেয়ে ধর্মীয় ভাবাবেগ ঢের বেশি। মেরুকরণের রাজনীতিতে সেই মানসিকতারই সুফল পেয়েছে বিজেপি। অন্য দিকে, সংখ্য়ালঘু প্রধান এলাকাগুলিতে কংগ্রেসের ভোটে থাবা বসিয়েছে আসাদউদ্দিন ওয়েইসির দল ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম)।
তা ছাড়া ভোটের ফলে স্পষ্ট, বিজেপি বিরোধী পাটীদার ভোটের পাশাপাশি সরাসরি কংগ্রেসের অনগ্রসর ও দলিত ভোটে থাবা বসিয়েছে আপ। ভোটের পাটিগণিত বলছে, বহু আসনেই আপ এবং কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটিতে জিতে গিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী। দীর্ঘ দিন কংগ্রেসকে ভোট দিয়ে হতাশ হওয়া বিজেপি বিরোধী ভোটারদের একাংশ আপের দিকে ঝোঁকায় সৌরাষ্ট্র, দক্ষিণ গুজরাত এমনকি, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র সীমানা লাগোয়া জনজাতি অধ্যুষিত আসনগুলিতেও ধরাশায়ী হয়েছে কংগ্রেস। অথচ গত বিধানসভায় ওই এলাকাগুলিতে ভাল ফল করেছিলেন ‘হাত’ চিহ্নের প্রার্থীরা।
নির্বাচনী পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮৫ সালের পর মহাত্মা গান্ধীর রাজ্যে কোনও বিধানসভা ভোটে জেতেনি কংগ্রেস। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় জনতা দল-বিজেপির জোট ভাঙার পরে মুখ্যমন্ত্রী চিমনভাই পটেল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায়, পিছনের দরজা দিয়ে কিছু দিন ক্ষমতা ভোগের সুযোগ হয়েছিল। এর পর ১৯৯৬ সালে বিদ্রোহী বিজেপি নেতা শঙ্করসিন বঘেলা, দিলীপ পারিখদের মদত দিয়ে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পটেলকে সরানো সম্ভব হলেও ১৯৯৮ সালের বিধানসভা ভোটের পর থেকেই গুজরাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ধারা তৈরি করে ফেলে পদ্ম-শিবির। টানা সপ্তম বার প্রবলতর আকার নিয়ে বজায় রইল সেই ধারা।