বিনয় কাটিয়ার। —নিজস্ব চিত্র।
বিনয় কাটিয়ার। রামজন্মভূমি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখন জঙ্গিবাহিনীর দরকার হয়ে পড়েছিল, তখন তাঁকেই বেছেছিল সঙ্ঘ পরিবার। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শাখা হিসাবে কাটিয়ারের নেতৃত্বেই তৈরি হয়েছিল ‘বজরং দল’ নামে সংগঠন। গোটা দেশের প্রশিক্ষিত কর্মীদের তিনি জড়ো করেছিলেন ১৯৯০ এবং ১৯৯২ সালে। প্রথম বার করসেবকেরা বিতর্কিত সৌধের মাথায় গেরুয়া পতাকা তুলেছিলেন। দ্বিতীয় বার ধুলোয় মিশেছিল সৌধ। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কাটিয়ার। এখন তিনি রাজনীতি থেকে দূরের মানুষ। আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘এখন আমার অবসর জীবন। বই পড়ে সময় কাটাই। নিস্তরঙ্গ জীবন বেশ উপভোগ করছি।’’
মঙ্গলবার সকালে অযোধ্যার মূল মন্দিরের কাছে কনক ভবনের ঠিক পিছনে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল চারদিক সুনসান। একটা সময়ে এখানে দিনরাত ভিড় লেগে থাকত। বড় লোহার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকার পরে প্রথম নিরাপত্তা রক্ষীর দেখা মিলল। আগে থেকে বলা ছিল। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের কর্মী দেখিয়ে দিলেন বাড়ির ভিতরে যাওয়ার রাস্তা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই নেমে এলেন কাটিয়ার। এখনও শক্ত, সবল শরীর। গেরুয়া ধুতির উপরে ধূসর সোয়েটার। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
কেমন লাগল সোমবারের অনুষ্ঠান? স্বপ্ন তো সফল? কাটিয়ার বললেন, ‘‘খুব সুন্দর, অপূর্ব অনুষ্ঠান হয়েছে। রামলালার যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানে যেতে পেরেছেন। এটা তো আনন্দেরই।’’ লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশীর কথা উদ্বোধনের সময়ে মনে পড়েনি? কাটিয়ার বললেন, ‘‘কী আর করা যাবে? বয়স একটা ব্যাপার। ওঁরা আসতে পারলে খুবই ভাল লাগত। কিন্তু অসুস্থ শরীর এতটা ধকল নিতে পারত না। বয়স হলে তো দূরে থাকতেই হয়। আমিও যেমন সব কিছু থেকে দূরেই রয়েছি।’’
কানপুরে জন্ম, কানপুরেই লেখাপড়া। বিদ্যার্থী পরিষদের মাধ্যমে গেরুয়া রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৭০ থেকে ’৭৪ পর্যন্ত রাজ্যের সংগঠন সম্পাদক ছিলেন। এর পর সঙ্ঘের প্রচারক হয়ে যান। ১৯৮২ সালে তিনিই ‘হিন্দু জাগরণ মঞ্চ’ নামে সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠন তৈরি করেন। ১৯৮৪ সালে ‘বজরং দল’। যে সংগঠনের জন্মই হয়েছিল মূলত রামজন্মভূমি আন্দোলনকে বড় চেহারা দেওয়ার জন্য। একটা সময়ে ‘জঙ্গি নেতা’ বলেই পরিচয় হয়ে যায় কাটিয়ারের। ১৯৯২ সালের পরে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল তাঁর সংগঠন।
সেই সময়ের কাহিনি মনে করাতেই কাটিয়ার খানিক ‘বিনয়ী’— ‘‘আমি কিছুই করিনি। সবই করেছে হিন্দুশক্তি। আমায় যে দায়িত্ব দিয়েছিল সংগঠন, তা আমি পালন করে গিয়েছি। সংগঠন মজবুত হয়ে গেলে কাজ কমে যায়।’’ সৌধ ধ্বংসের দিনটা মনে করিয়ে বললেন, ‘‘৬ ডিসেম্বর কী ভাবে কী হবে সবটা ঠিক করা ছিল আমার কাজ। সেই মতো করেছি। তার পরে ভেঙে গেল।’’ শুধুই কি ভেঙে গেল? আর কী কী করেছিলেন সে দিন। মুখে হাসি ফুটিয়ে কাটিয়ার আবার একই কথা বললেন, ‘‘ভেঙে গেল।’’
ওই ঘটনার পরে একের পর এক মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে কাটিয়ারকে। বিজেপি তত দিনে নিয়ে নিয়েছে তাঁকে। ২০০২ সালে উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সভাপতি। ২০০৪ সালে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। অযোধ্যা থেকে লোকসভায় গিয়েছেন তিন বার। ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ১৯৯৯ সালে। এর পরে উত্তরপ্রদেশ থেকে দু’বার রাজ্যসভাতেও। তবে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের জমানায় মাত্র চার বছর ছিলেন সংসদে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে শেষ হয় মেয়াদ। তখনও বার বার রামমন্দিরের দাবি তুলেছিলেন।
রামমন্দির আন্দোলন থেকে মন্দিরে রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা। পুরো পর্যায়ের জন্য আডবাণী এবং নরেন্দ্র মোদীকে দশের মধ্যে কত করে নম্বর দেবেন? রাজনীতিক কাটিয়ার একটু থেমে বললেন, ‘‘তুলনাই করব না। কারও করা উচিত নয়। আডবাণীজি ছিলেন তাঁর মতো করে শ্রেষ্ঠ। মোদীজি তাঁর মতো করে। আর সময়টাও অনেক বদলে গিয়েছে।’’ সেই প্রসঙ্গেই বললেন, ‘‘যে রামমন্দির হল, সেটা কোনও একটা প্রজন্মর চেষ্টায় বললে ভুল বলা হবে। এক একটা প্রজন্ম এক একটা কাজ করেছে। সেই ভিতের উপরে দাঁড়িয়ে এখন যে কাজ হচ্ছে, সেটাকেও ছোট করে দেখা ঠিক হবে না।’’
বাড়ির বারান্দাটা লোহার খাঁচা দিয়ে ঘেরা। কারণ, নিত্য রামভক্তদের আগাগোনা। কথার মধ্যে ঢুকেও পড়েছিল দুই হনুমান। কাটিয়ার নিজেই উঠে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে এসে বসলেন।
একটা সময়ে অনলবর্ষী বক্তা ছিলেন। এখন ধীরে ধীরে কথা বলেন। ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে ‘মিম’-এর প্রধান তথা তৎকালীন সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েইসি দাবি তুলেছিলেন, যাঁরা ভারতীয় মুসলিমদের ‘পাকিস্তানি’ বলেন, আইন করে তাঁদের অন্তত তিন বছরের কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। জবাবে কাটিয়ার বলেছিলেন, ‘‘ভারতেই থাকা উচিত নয় মুসলিমদের। জনসংখ্যার ভিত্তিতে তাঁরা দেশকে ভাগ করেছেন। তার পরেও তাঁরা এখানে কেন? মুসলিমদেরকে তো তাঁদের ভাগ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে যাওয়া উচিত।’’ এখনও কি তিনি সেই দাবি করেন? মোদী, মোহন ভাগবত তো ‘সবার রাম’ স্লোগান তুলছেন? কাটিহারের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘পুরনো কথা এখন থাক না।’’
তবে তাজমহল নিয়ে পুরনো মনোভাব এখনও বজায় রেখেছেন। তাজমহলকে ‘তেজমহল’ বানানোর দাবি তিনিই প্রথম তুলেছিলেন। ২০১৮ সালে ‘তাজ মহোৎসব’ অনুষ্ঠানে রাম নিয়ে নৃত্যনাটিকার আয়োজন করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। সেই সময়েও কট্টর হিন্দুত্ববাদী কাটিয়ারের মন্তব্য ছিল, ‘‘তাজ উৎসব হোক বা তেজ উৎসব— তাতে কী আসে-যায়? সেখানে আগে মন্দির ছিল। মন্দিরই হবে সেখানে।’’ সেই প্রসঙ্গ তুলতে কাটিয়ার বললেন, ‘‘তাজমহলে আগে শিবের মন্দির ছিল। সেটি তেজো মহালয় নামে পরিচিত ছিল। মন্দির বদলে সেটি ইসলামিক সৌধ বানানো হয়েছে।’’ এ বার কি সেই আন্দোলন হবে? কাশী-মথুরা নিয়েও কি সরব হবে বিজেপি? কাটিয়ার বললেন, ‘‘আমি জানি না। এখন যাঁরা নেতা রয়েছেন তাঁরাই ঠিক করবেন। তবে এখন মনে হয় সে ভাবে কিছু হবে না।’’
তিনি কিছু করবেন না? তাঁকে আবার আগের ভূমিকায় দেখা যাবে না? ‘পরিবর্তিত’ কাটিয়ার বললেন, ‘‘আমি এখন আর কিছুতেই নেই। কোনও দায়িত্বও নেই। সারা দিন বই পড়ি। গাছের যত্ন নিই। রামনাম করি। দিন কেটে যায়। আমার তো বয়সও হয়েছে।’’ কতই বা বয়স তাঁর? তিনি তো বয়সে মোদীর চেয়েও ছোট। জবাব দিলেন না। হাসলেনও না। কথাবার্তা শেষ হয়ে গিয়েছে বুঝিয়ে দিয়ে মিঠে সুরে বললেন, ‘‘জয় সিয়ারাম।’’