ফাইল চিত্র।
ভোটের আগে তড়িঘড়ি সেতু-ভবন-প্রকল্প শিলান্যাস-উদ্বোধনের সে কী ধুম! কিন্তু ২৫ বিঘা জমি জুড়ে, ১১টা বাড়ির যে ক্লাস্টারটা তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে, তা তো এই সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প! তার শিলান্যাসে গা নেই কেন অসমের বিজেপি সরকারের? আসলে ৪৬ কোটির ঘেরাটোপটার সঙ্গে যে কোনও গর্ব জড়িয়ে নেই। আছে লজ্জা আর আতঙ্ক। আইন বনাম অমানবিকতা, ভিটেমাটি বনাম প্রমাণপত্রের অসম লড়াইয়ের মূর্ত প্রতীক গোয়ালপাড়ায় নবনির্মিত ডিটেনশন সেন্টার এখন উদ্বোধনের উপেক্ষায়।
নামের আগে ‘ডি’ আর ঠিকানায় ‘ডিটেনশন সেন্টার’ যাঁদের, তাঁদের নাম ভোটার তালিকায় নেই। যাঁদের নাম ভোটার তালিকায় আছে? তাঁদের জন্য আছে এক সমুদ্র আতঙ্ক। আর সেই আতঙ্ক জিইয়ে রাখা হচ্ছে। ‘আমাদের’ ভোট না-দিলে কিন্তু ‘ওদের’ মতোই হাল হতে পারে! হয়তো সেই কারণে গত পাঁচ বছরে ডি-ভোটারের নোটিস পড়েছে আরও বেশি! ‘তারিখ পে তারিখ’ জমছে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে। বাঙালির পাশাপাশি হাজোং, রাজবংশী, আদিবাসীরাও তার শিকার।
বিজেপির দাবি, তারা শুদ্ধ এনআরসি তৈরি করবে, বেশি করে ফরেনার্স ট্রাইবুনাল গড়বে। আবার সরকারি ঘোষণা, রাজ্যে ১০টি ডিটেনশন সেন্টার হবে। বাঙালি মঞ্চ ও সংখ্যালঘু ছাত্র সংগঠনের নেতারা বলছেন, যদি প্রকৃত ভারতীয়দের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই হয়, তবে ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের দলে দলে জেলে পুরতে এত আড়ম্বর কেন?
গত বছর পর্যন্ত ছ’টি ডিটেনশন সেন্টারে মারা গিয়েছেন ৩০ জন। তাঁদের মধ্যে ২৬ জনই বাংলাভাষী। বাকিরা আদিবাসী ও কোচ-রাজবংশী। আইন-আদালত যা করতে পারেনি, মৃত্যু কিন্তু এক নিমেষে তা করে দিয়েছে। জীবিত অবস্থায় যাঁরা আদালতসিদ্ধ বিদেশি ছিলেন, মরতেই হয়ে গেলেন ভারতীয়! মরদেহ বাড়ি পাঠাতে প্রশাসনের কী চাপাচাপি! সুব্রত দে, নরেশ কোচ, ফালু দাস, রাবেদা বেগম- সকলেই এমন মরণোত্তর ভারতীয়। সরকারি খাতা বলছে, ৩০ জনের মধ্যে তিন জনের ঠিকানা বাংলাদেশের। তা হলে মারা যাওয়ার পরে কেন সেই নগেন দাস, বাসুদেব বিশ্বাস, দুলাল মিঁয়ার দেহ ‘আসল ঠিকানা’য় না পাঠিয়ে ভারতের বাড়িতে পাঠানো হল?
ডিটেনশন শিবির আর এনআরসি যখন ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের এক বন্ধনীতে এনে ফেলছিল,তখনই আনা হল সিএএ। ব্যাস, মেরুকরণের সরকারি উদ্দেশ্য সফল। বাংলাভাষী দ্বিখণ্ডিত।
কংগ্রেস সিএএ-বিরোধী। তাই তাদের বাঙালি নেতারা পড়েছেন উভয় সঙ্কটে। দলের মুখপাত্র অভিজিৎ মজুমদার বলেন, সিএএ এনে বিজেপি আগে বাঙালিদের বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী হিসেবে সিলমোহর মেরে নেবে। তার পরে দেবে দয়ার নাগরিকত্ব। যে ভাবেই হোক, অসমের এক-তৃতীয়াংশ বাঙালিকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে।
২০১১ সালের সুমারি বলছে, অসমে প্রতি দশ হাজারে অসমিয়াভাষীর সংখ্যা ৪৮৩৮ জন, যা ২০০১ সালে ছিল ৪৯৪৪ জন। বাংলাভাষীর সংখ্যা এই এক দশকে ২৭৯১ থেকে বেড়ে ২৮৯২ হয়েছে। বড়োভাষীর সংখ্যা ৪৯৩ থেকে কমে ৪৫৪ হয়েছে। আবার হিন্দিভাষী ৫৯৭ থেকে বেড়ে ৬৭৩ হয়েছে। এই পরিসংখ্যান হাতিয়ার করে আরও খড়্গহস্ত আলফা স্বাধীন থেকে শুরু করে অন্য আঞ্চলিকতাবাদীরা। বলা হচ্ছে, এর পর সিএএ বলবত হলে হিন্দু বাংলাদেশির সংখ্যা ৩০-৪০ লক্ষ বাড়বে।
অসম জাতীয় পরিষদের সভাপতি লুরিণজ্যোতি গগৈ বলেন, “আমাদের লড়াই কিন্তু বাঙালিদের বিরুদ্ধে নয়। অসম চুক্তি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সব বাঙালিকে অসমের মানুষ হিসেবে মেনেই নিয়েছিল। কিন্তু সিএএ এমন অসাংবিধানিক চক্রান্ত, যার ফলে ১৯৭১ সালের আগেকার অসমবাসী বাঙালিদেরও সকলে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন।”
বাঙালি ঐক্য মঞ্চের নেতা অমৃতলাল দাস বলেন, “কংগ্রেসের সিএএ বিরোধী নীতি ও নেতৃত্বহীনতায় বাঙালি আস্থাহীন। এ দিকে বিজেপির আইটি সেল ভয় আর উস্কানির মগজধোলাই চালাচ্ছে। রক্তকরবীতে একটি সংলাপ ছিল, ‘যক্ষপুরীর ভালো যে কার ভালো সে কথা স্পষ্ট বুঝতে পারচিনে।’ অসম ভোটে বাঙালিরও হয়েছে সেই দশা।”