গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ৪১৩ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
১১০ দিন— শূন্য থেকে এক লক্ষ
১৫ দিন— এক লক্ষ থেকে দু’লক্ষ
১০ দিন— দু’লক্ষ থেকে তিন লক্ষ
৮ দিন— তিন লক্ষ থেকে চার লক্ষ
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এ ভাবেই বাড়তে বাড়তে রবিবার চার লাখ ছাড়িয়ে গেল। দ্রুত হারে আক্রান্ত বৃদ্ধির এই পরিসংখ্যান প্রশাসন থেকে বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকদের কপালে ভাঁজ ফেলতে যথেষ্ট। দেশে অনেকাংশেই লকডাউন উঠে গিয়েছে। লোকাল ট্রেন, মেট্রো এবং আন্তর্জাতিক উড়ান বাদ দিলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় পুরোটাই চালু হয়ে গিয়েছে। এ ভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে শেষ পর্যন্ত তা কোথায় গিয়ে থামবে, সে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তার কারণ রয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৫ হাজার ৪১৩ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টায় বৃদ্ধির হিসাবে যা এখনও অবধি সর্বাধিক। এক দিনে এত সংখ্যক মানুষ এর আগে আক্রান্ত হননি। এই বৃদ্ধির জেরে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা হল চার লক্ষ ১০ হাজার ৪৬১ জন।
আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুও বাড়ছে ধারাবাহিক ভাবে। ১৭ জুন এক দিনে দু’হাজার মৃত্যুতে হইচই পড়েছিল দেশে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার থাবায় দেশে মৃত্যু হয়েছে ৩০৬ জনের। এ নিয়ে দেশে মোট মৃত্যু হল ১৩ হাজার ২৫৪ জনের। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রেই মৃত্যু হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৮৪ জনের। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজধানী দিল্লিতে মৃত্যু ধারাবাহিক ভাবে বেড়েছে। করোনার প্রভাবে সেখানে মোট দু’হাজার ১১২ জনের মৃত্যু হল। তৃতীয় স্থানে থাকা গুজরাতে মারা গিয়েছেন এক হাজার ৬৩৮ জন। এর পর তালিকায় রয়েছে তামিলনাড়ু (৭০৪), পশ্চিমবঙ্গ (৫৪০), উত্তরপ্রদেশ (৫০৭), মধ্যপ্রদেশ (৫০১), রাজস্থান (৩৩৭), তেলঙ্গানা (২০৩) ও হরিয়ানা (১৪৯), কর্নাটক (১৩২) ও অন্ধ্রপ্রদেশ (১০১)।
৩০ জানুয়ারি কেরলে দেশের প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। চিনের উহান থেকে ফিরেছিলেন সেই ব্যক্তি। তার পর কেটে গিয়েছে চার মাসেরও বেশি। ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। কোনও কোনও রাজ্যে তা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি রুখে দিয়েছিল কেরল। কিন্তু মহারাষ্ট্রে তা বল্গাহীন ভাবেই বেড়েছে। গোড়া থেকেই এই রাজ্য কার্যত সংক্রমণের শীর্ষে ছিল। তার পর সময় যত গড়িয়েছে, এই রাজ্য নিয়ে সারা দেশের শঙ্কা বেড়েছে। লক্ষাধিক সংক্রমণ ও পাঁচ হাজারের উপর মৃত্যু নিয়ে দেশের শীর্ষে রয়েছে সে। গত ২৪ ঘণ্টায় তিন হাজার ৮৭৪ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন সেখানে। এ নিয়ে সেখানে মোট আক্রান্ত হলেন এক লক্ষ ২৮ হাজার ২০৫ জন। এর পরই রয়েছে তামিলনাড়ু। সেখানে মোট আক্রান্ত ৫৬ হাজার ৮৪৫ জন। লকডাউন যত শেষ হতে লাগল দিল্লিতে সংক্রমণ ততই বাড়তে থাকল। সেখানে এখন মোট আক্রান্ত ৫৬ হাজার ৭৪৬ জন। চতুর্থ স্থানে থাকা গুজরাতে মোট আক্রান্ত ২৬ হাজার ৬৮০ জন। দেশের মোট সংক্রমণের মধ্যে ৬৫ শতাংশই এই চারটি রাজ্য থেকে।
উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ ও হরিয়ানা ১০ হাজারের গণ্ডি পার করে এগিয়ে চলেছে। উত্তরপ্রদেশ (১৬,৫৯৪), রাজস্থান (১৪,৫৩৬), পশ্চিমবঙ্গ (১৩,৫৩১), মধ্যপ্রদেশে (১১,৭২৪) ও হরিয়ানা (১০,২২৩) জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর পর ক্রমান্বয়ে রয়েছে কর্নাটক (৮,৬৯৭), অন্ধ্রপ্রদেশ (৮,৪৫২), বিহার (৭,৫৩৩), তেলঙ্গানা (৭,০৭২) ও জম্মু ও কাশ্মীর (৫,৮৩৪)। সংক্রমিতের সংখ্যা পাঁচ হাজারের নীচে রয়েছে অসম (৪,৯০৪), ওড়িশা (৪,৮৫৬), পঞ্জাব (৩,৯৫২), কেরল (৩,০৩৯), উত্তরাখণ্ড (২,৩০১), ছত্তীসগঢ় (২,০৪১), ঝাড়খণ্ড (১,৯৬৫) ও ত্রিপুরা (১,১৮৬)-র মতো রাজ্যগুলির।
লকডাউন উঠে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গেও সংক্রমণ বৃদ্ধিটা বেড়েছে। ভিন রাজ্য থেকে ফেরা শুরু হতেই কলকাতার আশপাশ ছাড়িয়ে জেলাগুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছে করোনা। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৪১ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন এ রাজ্যে। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত হলেন ১৩ হাজার ৫৩১ জন। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মোট ৫৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে রাজ্যে।
প্রথম সংক্রমণ থেকে দেশে মোট আক্রান্ত চার লক্ষ পৌঁছাতে সময় লেগেছে ১৪৩ দিন। আক্রান্তের গন্ডিকে লক্ষ হিসাবে ভাগ করলে দেখা যাবে, শূন্য থেকে এক লক্ষে পৌঁছতে লেগেছিল ১১০ দিন। এই বৃদ্ধিকালের সময় দেশ জুড়ে জারি ছিল লকডাউন। কিন্তু এক লক্ষ থেকে সংক্রমণ দু’লক্ষে পৌঁছতে সময় নিল মাত্র ১৫ দিন। তিন লক্ষে পৌঁছতে ১০ দিন ও চার লক্ষে পৌঁছতে আট দিন। যদিও এক লক্ষ পৌঁছনোর সঙ্গে দু’লক্ষ বা তিন লক্ষ পৌঁছনোর তুলনা হয় না। তবে সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রবণতা ফুটিয়ে তোলে এই তথ্য।
এক থেকে দু’জন, দুই থেকে চার জন, চার থেকে ষোলো জন— এ ভাবেই বাড়তে থাকে করোনা সংক্রমণ। করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত কি না তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে আক্রান্তের সংস্পর্শে এলে এই রোগ ছড়ায়। তাই আক্রান্তের সংখ্যা যত বাড়তে থাকে সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও তত বাড়ে। দেশে লকডাউন উঠে গিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটাই শুরু হয়েছে। রোজ রাস্তায় প্রচুর লোক। তাঁরা একে অপরের সংস্পর্শে আসছেন। পাশাপাশি প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্ত হওয়া বাড়ছে। শেষ ৩৩ দিনে তিন লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন দেশে। এই হারে যদি বাড়তে থাকে তাহলে পাঁচ লক্ষে পৌঁছতে আরও কম সময় লাগবে। প্রতিদিন নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কি এ ভাবে বাড়তেই থাকবে? বাড়লেও আরও কত দিন বাড়বে? কবে থেকে কমতে শুরু করবে? শেষ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা কত হবে?— এই সব প্রশ্ন দিনে দিনে জাঁকিয়ে বসছে।
সংক্রমণ বৃদ্ধি, মৃত্যু উদ্বেগ বাড়ালেও বিশ্বের নিরিখে ভারত স্বস্তির জায়গাতেই রয়েছে। ইউরোপ আমেরিকার থেকে ভারতে মৃত্যুর হার অনেক কম। আর সেটা ছিল শুরু থেকেই। কেন কম, সেটা গবেষণার বিষয়। তবে এই পরিসংখ্যান স্বস্তিদায়ক। আবার দেশের মোট জনসংখ্যার হিসাবে সংক্রমণ ধরলেও, ভারত বেশ ভাল জায়গায় রয়েছে। কম জনসংখ্যার দেশগুলিতে যত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, সেই তুলনায় ভারতে মোট আক্রান্ত অনেক কম। সারা বিশ্বে জনসংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হলেও সংক্রমণের নিরিখে এখনও ভারত চতুর্থ স্থানে। যদিও প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা আমেরিকা ও ব্রাজিলের থেকে ভারতের মোট সংক্রমিতের ফারাকটা বিশাল। মোট মৃত্যুর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা এ রকমই। ব্রাজিল, আমেরিকাতো বটেই। স্পেন, ইটালি, ফ্রান্স, ব্রিটেনের মতো কম জনসংখ্যার দেশগুলির তুলনায় ভারতে মৃত্যু এখনও অনেক কম।
আবার সুস্থ হয়ে ওঠার হিসেবও স্বস্তি দিয়েছে ভারতবাসীকে। এখন দেশে সুস্থ হয়ে করোনা রোগীর সংখ্যা সক্রিয় করোনা আক্রান্তের (মোট আক্রান্ত থেকে মৃত ও সুস্থ হয়ে ওঠা বাদ দিয়ে) সংখ্যার চেয়ে বেশি। মোট আক্রান্তের অর্ধেকেরও বেশি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। ফলে সংখ্যাটা ইতিমধ্যেই দু’লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ হাজার ৯২৫ জন সুস্থ হয়েছেন। যা এখনও অবধি সর্বাধিক। এ নিয়ে মোট দু’লক্ষ ২৭ হাজার ৭৫৬ জন করোনার কবল থেকে মুক্ত হলেন।
(গ্রাফের উপর হোভার বা টাচ করলে প্রত্যেক দিনের পরিসংখ্যান দেখতে পাবেন। চলন্ত গড় কী এবং কেন তা লেখার শেষে আলাদা করে বলা হয়েছে।)
(চলন্ত গড় বা মুভিং অ্যাভারেজ কী: একটি নির্দিষ্ট দিনে পাঁচ দিনের চলন্ত গড় হল— সেই দিনের সংখ্যা, তার আগের দু’দিনের সংখ্যা এবং তার পরের দু’দিনের সংখ্যার গড়। উদাহরণ হিসেবে— দৈনিক নতুন করোনা সংক্রমণের লেখচিত্রে ১৮ মে-র তথ্য দেখা যেতে পারে। সে দিনের মুভিং অ্যাভারেজ ছিল ৪৯৫৬। কিন্তু সে দিন নতুন আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ৫২৬৯। তার আগের দু’দিন ছিল ৩৯৭০ এবং ৪৯৮৭। পরের দুদিনের সংখ্যা ছিল ৪৯৪৩ এবং ৫৬১১। ১৬ থেকে ২০ মে, এই পাঁচ দিনের গড় হল ৪৯৫৬, যা ১৮ মে-র চলন্ত গড়। ঠিক একই ভাবে ১৯ মে-র চলন্ত গড় হল ১৭ থেকে ২১ মে-র আক্রান্তের সংখ্যার গড়। পরিসংখ্যানবিদ্যায় দীর্ঘমেয়াদি গতিপথ সহজ ভাবে বোঝার জন্য এবং স্বল্পমেয়াদি বড় বিচ্যুতি এড়াতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়)