সাংবাদিক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন।—ছবি এএফপি।
গত কাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী খামের উপরে ২০ লক্ষ কোটি টাকা লেখা দেখিয়েছিলেন। আজ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সেই খাম খুললেন বটে। কিন্তু তার ভিতরে কত টাকা রয়েছে, তা জানালেন না।
করোনা-সঙ্কট ও লকডাউনের গ্রাস থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করতে মঙ্গলবার রাত ৮টায় মোদী ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। বলেছিলেন, বুধবার থেকে প্যাকেজের খুঁটিনাটি জানাবেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। আজ প্রথম দিনে মূলত ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য সুরাহার ঘোষণা করেছেন তিনি। পাশাপাশি, ব্যাঙ্ক ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আবাসন ও সংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য কিছু ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পকে উদ্ধার করতে মূলত ব্যাঙ্কের ঋণের উপরেই ভরসা করেছেন অর্থমন্ত্রী। আমজনতার হাতে নগদ তুলে দেওয়া বা সরকারি খরচ বাড়ানোর কোনও কথা বলেননি।
অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন, সাধারণ মানুষের হাতে টাকা না-এলে বা সরকারি খরচ না-বাড়লে বাজারে চাহিদা বাড়বে কী করে? অর্থনীতিই বা কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াবে? দিল্লির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি-র অর্থনীতিবিদ লেখা চক্রবর্তী বলেন, “অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় বাজারে চাহিদা বাড়ানো, মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার মতো একটা কথাও নেই। টিডিএস-এর হার কমিয়ে এরকম অভূতপূর্ব সঙ্কটের মোকাবিলা হতে পারে না। পরিযায়ী শ্রমিক, গরিব মানুষ কী পান, দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু কিছুই মিলল না। অর্থমন্ত্রী যে-ঘোষণা করলেন, তার মধ্যে সরকার কতখানি খরচ করছে, তা-ও বোঝা গেল না।” বস্তুত আজ অর্থমন্ত্রীকে ঠিক এই প্রশ্নই করা হয়েছিল যে, ২০ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে সরকার কতটা খরচ করবে? সীতারামন তার উত্তর দেননি। শুধু বলেছেন, ধাপে ধাপে সব ঘোষণার পরেই তা স্পষ্ট হবে।
আজ অর্থমন্ত্রী ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পকে বন্ধক ছাড়াই তিন লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। সেই সঙ্গে ছোট-মাঝারি শিল্পের সংজ্ঞা বদলে বছরে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যবসা করে, এমন সংস্থাকেও মাঝারি শিল্পের আওতায় এনেছেন। ফলে অনেক বড় মাপের সংস্থাই এর ফায়দা পাবে। প্রশ্ন, বিজেপির নিজস্ব ভোট-ব্যাঙ্ক, ব্যবসায়ীদের খুশি করতেই কি এই ঘোষণা? বাজারে বিক্রিবাটা নেই, কারখানা বন্ধ। ফলে ঋণের দরকারও নেই। এই অবস্থায় ব্যাঙ্কগুলিকে ধমক দিয়ে ঋণ বিলি করানো হলে, তা আর শোধ হবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে।
ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য ছয় পদক্ষেপ
• পুঁজির অভাব মেটাতে ব্যাঙ্ক, এনবিএফসি থেকে ৩ লক্ষ কোটি টাকার বন্ধকহীন ঋণের ব্যবস্থা
• চাপের মুখে থাকা ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার সাব-অর্ডিনেট ডেট
• ‘ফান্ড অব ফান্ডস’-এর মাধ্যমে ৫০ হাজার কোটি টাকার ‘ইকুইটি ইনফিউশন’
• ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্পের সংজ্ঞা বদল
• ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত সরকারি ক্রয়ে ‘গ্লোবাল টেন্ডার’ ডাকা হবে না
• আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সমস্ত বকেয়া মিটিয়ে দেবে
প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেন, “লক্ষ লক্ষ গরিব, ক্ষুধার্ত মানুষ, রাস্তায় হাঁটতে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য অর্থমন্ত্রী কোনও ঘোষণা করেননি। কম আয়ের মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়ার কথাও বলেননি।” তাঁর হিসেবে নির্মলার এ দিনের ঘোষিত প্যাকেজের মূল্য ৩.৬ লক্ষ কোটি টাকা।
অন্য দিকে, আর্থিক বিশ্লেষকদের মতে, আজকের আর্থিক প্যাকেজের পরিমাণ খুব বেশি হলে ৫.৯ লক্ষ কোটি টাকা। তার মধ্যে সরকারি খরচ মেরেকেটে ৬০ হাজার কোটি টাকা।
আয়করে সুবিধা
• ২০২১-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত টিডিএস এবং টিসিএস ২৫ শতাংশ কমানো হবে। যা চুক্তি, পেশাদার ফি, ব্রোকারেজ, সুদ, ভাড়া, ডিভিডেন্ড, কমিশন— সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
• সমস্ত চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, নন-কর্পোরেট বিজনেস, প্রোপ্রাইটরশিপ, পার্টনারশিপ, এলএলপি, কো-অপারেটিভের জন্য অবিলম্বে আয়কর রিফান্ড
• ২০১৯-২০-র আয়কর রিটার্নের সময়সীমা বেড়ে ৩০ নভেম্বর, ২০২০। কর অডিটের সময়সীমা ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে বেড়ে ৩১ অক্টোবর, ২০২০
• অ্যাসেসমেন্টের সময়সীমা ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে বেড়ে ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০
• যাঁদের সময়সীমা ৩১ মার্চ, ২০২১-এ শেষ হচ্ছিল, তাঁদের বেড়ে ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১
• ‘বিবাদ সে বিশ্বাস’ প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০
ইপিএফ-এ জমার হার কমিয়ে দেওয়ায় মানুষের নগদ আয় বাড়বে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু তাতে কোনও সরকারি অবদান নেই। তা হলে তা কী ভাবে প্যাকেজে যোগ হচ্ছে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। মোদী সরকার কেন সরকারি খরচ ও ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ঋণ দিয়ে নগদ জোগানকে যোগ করে আর্থিক প্যাকেজ তৈরি করছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে চিদম্বরম বলেন, “বিশ্বের কোথাও সরকারি খরচের সঙ্গে ব্যাঙ্কের ঋণ যোগ করে আর্থিক প্যাকেজ দেখানো হয় না।”
আরও পড়ুন: এমএসএমই পুনরুজ্জীবনে ৩ লক্ষ কোটির প্যাকেজ, গ্যারান্টি ছাড়াই মিলবে ঋণ
অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসুর ব্যাখ্যা, “অর্থমন্ত্রী ঋণের জোগান বাড়াতে চাইছেন। কিন্তু অর্থনীতির মন্দ গতির সময়ে তাতে লাভ হয় না। কারণ, বাজারে চাহিদাই নেই, কে ঋণ নেবে! তার বদলে সরকারি খরচ বাড়ানো হলে বা মানুষের হাতে টাকা তুলে দিলে চাহিদা বাড়ত, আর্থিক বৃদ্ধিও বাড়ত।’’
এনবিএফসি, আবাসন ঋণ ও ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা
• মুশকিলে পড়া এনবিএফসি-র জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রকল্প। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এনবিএফসি-র ঋণপত্রে লগ্নি করবে।
• ৪৫ হাজার কোটি টাকার আংশিক ঋণ গ্যারান্টি প্রকল্প, প্রথম ২০ শতাংশ ক্ষতি সরকার বহন করবে
২০০৮-এর বিশ্ব জুড়ে আর্থিক সঙ্কটের মোকাবিলায় তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ বিলির ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে রাজকোষ ঘাটতি বাড়িয়ে সরকারি খরচও বাড়িয়েছিলেন। তাঁদের আর্থিক প্যাকেজের জন্য রাজকোষ ঘাটতি কতটা বাড়বে, সেই প্রশ্নের জবাব আজ সীতারামন দেননি। চিদম্বরমের মতে, “কেন্দ্রের উচিত খরচ বাড়ানো, সে জন্য আরও ধার করা। কিন্তু কেন্দ্র তাতে রাজি নয়। কেন্দ্রের উচিত রাজ্যগুলিকে আরও ধার করতে দেওয়া। তা-ও তারা করতে নারাজ।”